মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
কী হবে চলচ্চিত্রের

আটকে পড়া ছবির ভবিষ্যৎ কী

আলাউদ্দীন মাজিদ

আটকে পড়া ছবির ভবিষ্যৎ কী

হাহাকার বেড়েছে চলচ্চিত্র প্রযোজক আর প্রদর্শকদের মধ্যে। লোকসানের ঘানি টানতে গিয়ে জীবন নাভিশ্বাসে উঠেছে তাঁদের। এমনিতেই কয়েক দশক ধরে চলচ্চিত্র শিল্প আইসিইউতে রয়েছে। এমন দাবি বরাবরই করে আসছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ। তাঁর এই দাবি যথার্থ। কারণ নব্বই দশকের শেষ ভাগে যখন আচমকা অশ্লীলতা চলচ্চিত্রের ওপর জেঁকে বসে তখন গুণী নির্মাতা ও শিল্পীরা মানসম্মান বাঁচাতে চলচ্চিত্রাঙ্গন ছাড়েন। তাঁদের স্থান মহাসমারোহে দখল করে নেন নর্দমার কীট-পতঙ্গরা। তাদের উলঙ্গপনায় মানমর্যাদাসম্পন্ন দর্শকও সিনেমা হলবিমুখ হয়ে পড়েন। অশ্লীলতার সঙ্গে যুক্ত হয় পাইরেসি আর নকল। চলচ্চিত্র শিল্প হয়ে পড়ে অসহায়। নামিদামি প্রযোজনা সংস্থা আর সিনেমা হল বন্ধের দুঃখজনক অধ্যায় শুরু হয়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন নবাব-জমিদাররা, তা এসে পড়ে দুর্বৃত্তদের হাতে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ধস নেমেছে এই শিল্পে। এতে দেশি ছবির নাম শুনলে মানসম্পন্ন দর্শকরা নাক সিটকাতে শুরু করেন। এসব অবস্থা এখনো কমবেশি চলছে বলে দেশীয় চলচ্চিত্র আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। বর্তমান সরকারের নানামুখী উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও কিছু মানসম্মত নির্মাতা-শিল্পী মাঝে মধ্যে আশার আলো দেখালেও তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না। চলতি বছর এসব সমস্যার সঙ্গে বৈশ্বিক মহামারী করোনা যোগ হওয়ায় চলচ্চিত্র শিল্প বলতে গেলে চলে গেছে কোমায়। ১৮ মার্চ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস করোনার কারণে সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ থাকে। এতে আটকা পড়ে যায় প্রচুর নির্মাণাধীন ছবি। ১৬ অক্টোবর সিনেমা হল খুললেও বেশির ভাগ প্রযোজক ছবি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তাঁদের কথায় করোনার ভয়ে সিনেমা হলে দর্শক কতটা আসবে তাতে সন্দেহ থেকেই যায়, তার ওপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমা হলের অর্ধেক আসন খালি রাখতে গিয়ে চলচ্চিত্রে লগ্নিকৃত অর্থ কতটা ফেরত আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। প্রযোজকরা টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি চেয়েছেন প্রদর্শকদের কাছে আর প্রদর্শকরা বলেছেন ছবি যে মানসম্মত এই গ্যারান্টি আগেই দিতে হবে প্রযোজকদের। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে অক্টোবরে সিনেমা হল খোলার পরও ডিসেম্বর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছবি মুক্তি পায়নি। এতে হতাশ প্রদর্শকরা। অন্যদিকে প্রযোজকরা অনুকূল পরিবেশের অভাবে ছবি মুক্তি দিতে না পেরে হা-পিত্যেশ করছেন। করোনার কারণে যেসব ছবির মধ্যে কিছু নির্মাণ ও কিছু ছবির মুক্তি আটকে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘এডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, ‘জ্বীন’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ পর্ব-১, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘মন দেব মন নেব’, ‘নীল মুুকুট’, ‘পরাণ’, ‘নারীর শক্তি’, ‘বান্ধব’, ‘নীল ফড়িং’, ‘কানামাছি’, ‘দিন : দ্য ডে’, ‘গাঙচিল’, ‘জ্যাম’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘ইত্তেফাক’, ‘ক্যাসিনো’, ‘আকবর’, ‘ব্লাড’, ‘ওস্তাদ’, ‘মন্ত্র’, ‘কাপ্তান’, ‘কয়লা’, ‘এই তুমি সেই তুমি’, ‘টেনশন’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘ওস্তাদ’, ‘পাপ-পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘আদম’, ‘সিক্রেট এজেন্ট’, ‘ডেঞ্জারম্যান’, ‘ঢাকা-২০৪০’, ‘বিক্ষোভ’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘কমান্ডো’, ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’, ‘মেকআপ’, ‘সাইকো’ ‘বসন্ত বিকেল’, ‘সাহসী যোদ্ধা’, ‘পদ্মপুরাণ’সহ বেশকিছু ছবি। ছবি নির্মাণ বন্ধ ও মুক্তি দিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কতটা ভয়াবহ হয় সেই আশঙ্কায় পড়েছেন এখন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।

আটকে থাকা অনেক ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীও বলতে পারছেন না কবে থেকে এই ছবিগুলোর শুটিং শুরু হবে। কেননা নতুন করে তাঁদের কাছ থেকে শুটিং শিডিউলও নেননি পরিচালকরা। এগুলোর মধ্যে ‘ইত্তেফাক’ ছবির প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ  শেষ হয়েছে। প্রায় এক বছর হলো বন্ধ ছবির শুটিং। জানা গেছে, শুটিং হওয়া অংশটুকুর খরচ নিয়ে ছবির পরিচালক রায়হান রাফির সঙ্গে প্রযোজকের মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুরনো ছবি  রেখে এরই মধ্যে নতুন ছবির শুটিং শুরু করেছেন এই পরিচালক। এসব কারণে ‘ইত্তেফাক’ ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একই পরিচালকের স্বপ্নবাজি ছবিটি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছয় দিন শুটিং করার পর প্রায় ৯ মাস বন্ধ আছে ছবির কাজ। আবার কবে শুটিং শুরু করতে পারবেন, নিশ্চিত করতে পারেননি রায়হান রাফি। গত জানুয়ারি মাসে মাত্র দুদিন শুটিং হয়েছিল  সৈকত নাসির পরিচালিত ‘আকবর : ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ঢাকা’ ছবির। প্রায় ১১ মাস চলে গেলেও সেই ছবির কাজ আর শুরু হয়নি। এই ছবির শুটিং না করলেও এরই মধ্যে সৈকত নাসির নতুন ছবি ‘বর্ডার’-এর শুটিং শেষ করেছেন। ‘আ জার্নি উইথ ইউ’ নামে আরেকটি ছবির কিছু শুটিং করাও হয়ে গেছে। আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ‘ক্যাশ’ নামে আরেকটি নতুন ছবির শুটিং শুরু করবেন তিনি। এপ্রিল মাসে করবেন মাসুদ রানা। ‘আকবর’ ছবির বিষয়ে সৈকত নাসির বলেন, ‘এর আগে শুটিংয়ের জন্য প্রযোজককে বলেছিলাম। তখন তিনি করেননি। এখন আগামী বছরের শুরু থেকে আমার অনেক নতুন ছবির কাজ হবে। যদি ‘আকবর : ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ঢাকা’ ছবির কাজ করতে হয়, তাহলে আগামী বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের আগে শুরু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ওয়াজেদ আলীর ব্লাড ছবির শুটিং অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে গেছে। গত ৩ মার্চ ছবির মহরত হয়। ওই দিন ছবির নায়ক-নায়িকা ইমন ও মাহীকে নিয়ে একটি দৃশ্য ধারণ করা হয়। পরে ২৫ মার্চ  থেকে শুটিং শুরু করার কথা থাকলেও প্রায় ১০ মাস পার হতে চলল, শুটিংয়ের কোনো খবর নেই। পরিচালক বলেন, ‘২৫ মার্চ থেকে শুটিং করার কথা ছিল। কিন্তু প্রযোজকের দিক থেকে কোনো সাড়া পাইনি। অনেক দিন হলো প্রযোজকের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। এই ছবি আর না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।’ একদিকে যখন ছবি নির্মাণ আর মুক্তি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে ঠিক তখনই সিনেমা হলও একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘রাজমণি’ ও চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ‘আলমাস’ সিনেমা হল দুটি বন্ধের তালিকায় যুক্ত হলো। অথচ সরকার চলতি বছরই সিনেমা হল সংস্কারের জন্য এক হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। প্রদর্শকরা বলছে ছবিই যেহেতু নেই সেহেতু ঋণ নিয়ে সিনেমা হল সংস্কার করা মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। অন্যদিকে প্রযোজকরা বলছেন যেখানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ৯০টিরও কম সেখানে কমপক্ষে ৮০ লাখ টাকা দিয়েও যদি একটি ছবি নির্মাণ করা হয়, তবে সেই টাকা কীভাবে ওঠে আসবে। সবমিলিয়ে বলতে হয় দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব এখন একবারেই বিপন্ন। এরই মধ্যে আই থিয়েটার নামে চলচ্চিত্র মুক্তির জন্য দেশে প্রথম একটি অনলাইন প্ল্যাটফরম চালু হলে প্রযোজকরা আশার আলো দেখতে শুরু করেন। কিন্তু শুরুতেই এই ওটিটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতার কার্যকলাপে দর্শক চরম বিরক্ত হয়।  ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। এই ওটিটির উদ্যোক্তার অন্যতম একজন বিতর্কিত চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুন তাঁর ‘নবাব এলএলবি’ ছবিটি প্রদর্শন করতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দেয়। পুরো ছবি একসঙ্গে দেখানোর কথা বলে দর্শকদের কাছে টিকিট বিক্রি করে ১৬ ডিসেম্বর দেখায় অর্ধেক ছবি। এরপর ঘোষণা দেয় বাকি অর্ধেক দেখানো হবে পয়লা জানুয়ারি। এতে দর্শকদের দাবি নির্মাতা মামুন তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ কারণে এই নির্মাতার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মামলা দায়েরের চিন্তাও করছে অনেক দর্শক। নতুন অনলাইনটির ওপর দর্শক আস্থা নষ্ট করা এখানেই মামুনের কীর্তির শেষ নয়। দর্শকের কথায় যেহেতু অনলাইন প্ল্যাটফরমের জন্য ছবিটি নির্মাণ হয়েছে সেহেতু এটি দর্শক ড্রইংরুমে পরিবার নিয়ে বসে দেখবে। কিন্তু এখানেও হোঁচট খায় দর্শক। ছবির একটি দৃশ্যে ছবির নায়িকা ধর্ষণের শিকার স্পর্শিয়াকে পুলিশ অশ্লীল ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দর্শকদের পরিবার নিয়ে ছবি দেখতে বিব্রত করেছে। এ কারণে পুলিশ পর্নোগ্রাফি আইনে নির্মাতা অনন্য মামুন ও পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করা মৃধার বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁদের গ্রেফতার করেছে। আদালতের আদেশে তাঁরা এখন হাজতবাস করছেন। অশ্লীলতা রোধে পুলিশের এই উদ্যোগকে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা স্বাগত জানিয়েছে। চলচ্চিত্র প্রযোজকরা বলছেন, ভেবেছিলাম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের নতুন একটি প্ল্যাটফরম পেয়ে ব্যবসায়িক স্বস্তি এসেছে। কিন্তু মামুনের অনৈতিক কর্মকান্ডে তাও ভেস্তে গেল। কারণ শুরুতেই ওটিটির প্রতি দর্শক আস্থা নষ্ট হলো। প্রযোজকদের কথায় তাহলে এখন ছবি মুক্তি দেব কোথায়?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর