বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অনুদানের টাকায় চলছে এফডিসি...

আলাউদ্দীন মাজিদ

অনুদানের টাকায় চলছে এফডিসি...

আয় হারিয়ে এফডিসি এখন সরকারি অনুদাননির্ভর হয়ে পড়েছে। সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মেলে না সরকারি অনুদান ছাড়া। আবার গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে বকেয়া থাকে বেতন। গত রবিবার সরকার দ্বিতীয় দফায় ৭ কোটি টাকার অনুদান দেয় এফডিসিকে, আর তা দিয়ে পরিশোধ করা হয় বেতন ও অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আংশিক গ্র্যাচুয়িটি। এর আগে গত মে মাসে অনুদান হিসেবে এফডিসিকে সরকার দিয়েছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

এফডিসি প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির ২৫১ জন কর্মকর্তার মাসিক বেতনের পরিমাণ প্রায় ৯৮ লাখ টাকা। সঙ্গে বিদ্যুৎ, পানির বিল, উন্নয়ন কাজ, দৈনন্দিন খরচসহ মাসিক খরচ ১ কোটি টাকারও বেশি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া ছাড়াও পরিশোধ করা যাচ্ছে না এফডিসির চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া ৭৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর গ্র্যাচুয়িটি বাবদ প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এফডিসির আয়ের চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, করোনা মহামারীর কারণে গত বছরের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ খাতে ওই মাসে এফডিসির আয় ছিল মাত্র ৪৯ লাখ ২০ হাজার ১৫৬ টাকা এবং লকডাউন শেষ হলে গত সেপ্টেম্বর মাসে একই খাতে আয় হয় মাত্র ৪২ লাখ ৫২ হাজার ৯২৭ টাকা। এর পরবর্তী মাসগুলোর আয়ের চিত্রও প্রায় একই। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছে এফডিসি প্রশাসন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এফডিসিতে চলচ্চিত্রের কাজ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় ২০১০ সাল থেকে। তখন থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে এফডিসিতে ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের টেকনিক্যাল সাপোর্ট না থাকায় নির্মাতারা প্রাইভেট সেক্টর ও দেশের বাইরে চলে যান ডিজিটাল চলচ্চিত্রের কারিগরি কাজের জন্য। এরপর এফডিসির আধুনিকায়ন প্রকল্প ২০১৮ সালের দিকে সম্পন্ন হলেও ক্যামেরা ও সম্পাদনা বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগে বিশেষ করে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চালু হয়নি। নির্মাতাদের কথায় এফডিসিতে যন্ত্রপাতি ও ফ্লোরের ভাড়া প্রাইভেট সেক্টর থেকে বেশি। তাছাড়া এখানে কাজ করতে এলে টাকা জমা দিয়েও নানা শাখায় ঘুরতে হয়, মানে হয়রানির কবলে পড়ে কাজ শুরু করতে ্িবলম্ব ঘটে। বাইরে এসব সমস্যা নেই। বরং প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করতে গেলে নানা অফার ও যত্নআত্তি পাওয়া যায়। তবে এফডিসি কর্তৃপক্ষের মতে সবকিছুরই ভাড়া কমানো হয়েছে এবং নানা সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। তারপরও যদি নির্মাতারা বাইরে চলে যান তাহলে কি করার আছে। এফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সংস্থাটিতে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর শুটিং ফ্লোর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ৭, ৮ ও ৯ নম্বর শুটিং ফ্লোর বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে ভাড়া দেওয়া রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ৬ নম্বর শুটিং ফ্লোর অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। ভাড়ায় থাকা ফ্লোরগুলোর ভাড়াও নিয়মিত পাওয়া যায় না। শুটিংয়ের জন্য এফডিসিতে রয়েছে মাত্র ১ ও ২ নম্বর অর্থাৎ দুটি ফ্লোর। আয় কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে এফডিসি চিহ্নিত করেছে দুটি বিষয়কে। সংস্থার কথায় এফডিসির আয়ের প্রধান খাত ছিল নেগেটিভ বিক্রি ও নেগেটিভ পরিস্ফুটন। ৩৫ মিলিমিটারের যুগ শেষ হয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির নির্মাণ শুরু হলে এই দুটি খাত বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এনালগ আমলে এই দুই খাত থেকে যে আয় হতো তা দিয়ে এফডিসির যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আরও অর্থ জমা থাকত। ডিজিটাল যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে আয়ের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকে থাকা সংস্থাটির এফডিআর এর বিপরীতে ঋণ নিয়ে বেতন ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ হতো। একসময় তাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন থেকেই সরকারের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে চলতে থাকে সংস্থাটি। গত বছর করোনা মহামারী দেখা দিলে কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ফলে গত বছরের মে মাসেও ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা ‘সরকারি অনুদান’ নিয়ে মার্চ ও এপ্রিল মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছে এফডিসি। অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে আগস্ট পর্যন্ত বেতন দিতে পারলেও সেপ্টেম্বর থেকে ফের সংকটে পড়ে এফডিসি। এই সংকট মোচনে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ১৮ কোটি এবং অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুয়িটি পরিশোধে ১২ কোটি টাকা, মোট ৩০ কোটি টাকা চেয়ে গত ২৯ জুন তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এফডিসিকে ৩ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় ৭ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হলো। এর মধ্যে বকেয়া বেতন বাবদ ৫ কোটি ও অবসরে যাওয়া কর্মীদের জন্য ২ কোটি টাকা অনুদান দেয় সরকার। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বেতন না পেয়ে মালী, ক্লিনার, নিরাপত্তারক্ষীসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ২ শতাধিক কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। বেতন পাচ্ছিলেন না সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। এদিকে, অবসরে যাওয়া কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ হাতে না পাওয়ায় কিছুটা অস্বস্তি রয়েই গেছে বলে দাবি করছেন এফডিসির অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাঁদের মতে, অবসরে যাওয়া কর্মীরা তাঁদের পাওনা টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে তাঁদের মানবেতর দিন যাপন করতে হচ্ছে। তাঁদের প্রত্যাশা, কর্তৃপক্ষ অবসরে যাওয়া ওই কর্মীদের মুখে শিগগিরই হাসি ফুটানোর ব্যবস্থা করবে। অন্যদিকে এফডিসি নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কার কথা হলো, এভাবে সরকারি অনুদানে আর কতদিন চলবে এফডিসি। এভাবে চলতে থাকলে ১৯৫৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া চলচ্চিত্র নির্মাণের দেশীয় এই সূতিকাগারটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এফডিসি কর্তৃপক্ষ দুঃখের সঙ্গে জানায়, দেশের এই প্রধান গণমাধ্যমটি ২০১০ সাল পর্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। এফডিসির আয়ের প্রধান উৎস ছিল ফিল্মের কাঁচামাল বিক্রি এবং কালার ল্যাবে ফিল্ম পরিস্ফুটন। এই দুই খাতের আয় দিয়েই বেতন, ভাতা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করে আরও অর্থ এফডিসির ফান্ডে জমা থাকত। ২০১০ সালের পর ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে এই দুই এনালগ খাতে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এফডিসি আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। থেমে যায় সংস্থাটির স্বাভাবিক গতি। এর ওপর আবার গত বছর বৈশ্বিক মহামারী করোনাকাল শুরু হওয়ায় লকডাউনের কবলে পড়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজ বন্ধ ও কমে যাওয়ায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের কবলে পড়েছে এফডিসি।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, লোকসানের কবলে পড়া এফডিসিকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে বিশেষ করে চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ গাজীপুর ফিল্ম সিটিতে করলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে আর অস্তিত্ব বিলীনের কবল থেকে রক্ষা পেতে পারে তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এফডিসি। তেজগাঁওয়ে বর্তমান এফডিসির একটি অংশে নির্মাণাধীন রয়েছে এফডিসি কমপ্লেক্স। এখানে এটি গড়ে ওঠলে এর থেকে ভাড়াসহ নানা খাতে অর্জিত আয় দিয়ে গাজীপুর ফিল্ম সিটিতে সরিয়ে নেওয়া এফডিসির ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। আর বর্তমান এফডিসিতে কমপ্লেক্স ছাড়াও থাকতে পারে প্রশাসনিক অফিস এবং একটি জাদুঘর। যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট নানা তথ্যচিত্র ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন, চলচ্চিত্রের অতীতের মূল্যবান চিত্র, যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র প্রদর্শন করা যেতে পারে। তাছাড়া এখানে কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শনের জন্য একটি থিয়েটারও স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া থাকতে পারে চলচ্চিত্র নিয়ে নানা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা, কর্মশালা ও উৎসবসহ নানা কর্মকা-। দর্শনীর বিনিময়ে দর্শক টিকিট কেটে এসব দেখতে পারবে। আর টিকিট বিক্রির অর্জিত আয় হতে পারে এফডিসি পরিচালনার সহায়ক অর্থ তহবিল।

সর্বশেষ খবর