সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

৬৯ বছরে একুশের মাত্র তিনটি ছবি

আলাউদ্দীন মাজিদ

৬৯ বছরে একুশের মাত্র তিনটি ছবি

ভাষার জন্য আত্মত্যাগ পৃথিবীর বুকে একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে। তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এই মহান ভাষা দিবসের তাৎপর্য, ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগ আমাদের চলচ্চিত্রে খুব একটা ফুটে ওঠেনি। বিস্ময়কর হলেও বাস্তবতা এটাই, ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আত্মত্যাগের পর ৬৯ বছরে মাত্র তিনটি ছবির মধ্যেই আটকে আছে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ক্যানভাস। তাও আবার আংশিকভাবে। মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের কেন এমন দীনতা? চলচ্চিত্রকারদের কথায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার মতো প্রযোজক নেই। কারণ এ দেশের দর্শক নাকি এমন ছবিবিমুখ। এক্ষেত্রে সরকার ভূমিকা রাখতে পারে। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে যে তিনটি ছবি নির্মিত হয়েছে এবং যে দুটো হয়নি সেগুলো হলো-

 

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)

পরিচালক জহির রায়হান।

অভিনয়ে রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এই চলচ্চিত্রে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ প্রভৃতি গান ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে বাংলার মানুষকে। বড় বোনের চরিত্রে রওশন জামিলকে অত্যাচারী, শাসক হিসেবে দেখানোর মধ্য দিয়ে মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকেই রূপক অর্থে দেখানো হয়। ‘পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চলচ্চিত্র’- এই অভিযোগে চলচ্চিত্রটির শুটিংয়ের সময় জহির রায়হানকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী।

 

বাঙলা (২০০৬)

পরিচালনা শহীদুল আলম খোকন।

অভিনয়ে শাবনূর, হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ প্রমুখ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাবন্ধিক এবং চিন্তাবিদ আহমদ ছফার ওঙ্কার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র একজন বোবা স্ত্রী। কেবল ভাষার মিছিলই সেই নারীকে চঞ্চল, কৌতূহলী করে তোলে। বাংলায় চিৎকার করতে বলে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান একসময় সেই নারীকে স্পষ্টভাবে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করায়। তখনই তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে, সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেই রক্ত শহীদ আসাদের নাকি সেই বোবা বউয়ের, সিনেমা শেষে এই প্রশ্নটি দর্শকদের মনে গেঁথে যায়।

 

ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯)

পরিচালনা : তৌকীর আহমেদ।

অভিনয়ে : তিশা, সিয়াম, আবুল হায়াত, আফরোজা বানু, ফারুক হোসেন, সাজু খাদেম, রওনক হাসান, শহিদুল আলম সাচ্চু, আজাদ সেতু, বলিউডের অভিনেতা যশপাল শর্মা প্রমুখ।

টিটো রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্পের অনুপ্রেরণায় নির্মিত হয়েছে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমা। ছবিতে এক মফস্বল শহরে ভাষা আন্দোলনের সময় মানুষের ভাবনা, আন্দোলন আর চেতনাকে রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে। 

 

থেমে যায় আমজাদ হোসেনেরশহীদ আসাদ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘শহীদ আসাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে দিয়ে এ ছবির মহরতও করেছিলেন। কিন্তু পরে ছবিটি আর হয়নি। কারণ একটাই, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অনুমতি দেয়নি। ‘শহীদ আসাদ’ ছবিটির পরিকল্পনা থামিয়ে দিয়ে আমজাদ হোসেনও ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্য গল্পের ছবি নির্মাণে।

নির্মিত হয়নি জহির রায়হানেরএকুশে ফেব্রুয়ারি

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’, অমর একুশের এই গানটি সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন জহির রায়হান। পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে থেকেও ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদের বারুদ জ্বেলেছিলেন এই নির্ভীক নির্মাতা। ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণের আগে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন জহির রায়হান। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ছবিটি তৈরির সুযোগ দেয়নি তাঁকে। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে যে ছবিটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তার কাহিনিতে তিনি তুলে ধরেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক-কৃষক-জনতার সম্পৃক্ততা। গল্পে ছিল চারটি পরিবার, যারা সমাজের চারটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। একটি উচ্চবিত্ত, একটি মধ্যবিত্ত, একটি শ্রমিক ও একটি কৃষক দম্পতি, যাঁরা ঘটনাচক্রে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে এমন একটি জায়গায় একত্রিত হন, যেখানে ছাত্রদের মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। চিত্রনাট্যের শুরুতেই ছিল গুলির শব্দ, তারপরই একঝাঁক কাক আর্তকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে উড়ে বেড়ায় গোটা ঢাকা শহরের আকাশে। ধীরে ধীরে ফ্রেমে আসে রাজপথ, টাটকা রক্ত। নবারুণ ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল খান আতা, সুমিতা, রহমান, শবনম, আনোয়ার, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ শিল্পীর। ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময় জহির রায়হান চিত্রনাট্যটি এফডিসিতে জমা দেন অনুমোদনের জন্য। কিন্তু প্রশাসন এটি অনুমোদন দিতে আপত্তি জানায়। অনুমোদন পাওয়ার জন্য বছরখানেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন জহির রায়হান। সব আশা ত্যাগ করে ছবিটির চিত্রনাট্য তিনি ফেরত চান। কিন্তু চিত্রনাট্যটি তাঁকে আর ফেরত দেওয়া হয়নি। তৎকালীন এফডিসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায়, এটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

জহির রায়হানের সহধর্মিণী নায়িকা-নির্মাতা সুচন্দা জানান, সাময়িকভাবে হতাশ হলেও জহির রায়হান জীবনের শেষদিনেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবিটি নির্মাণের ইচ্ছা ত্যাগ করেননি। এ বিষয়ে জহির রায়হান সব সময়ই বলতেন, ভাষা আন্দোলনের মর্মকথা নিয়ে আমি বাঙালি জাতির দরবারে কোনো না কোনো দিন হাজির হবই। সুচন্দা দাবি করেন, এফডিসিতে সঠিকভাবে অনুসন্ধান চালালে মূল চিত্রনাট্যটি অবশ্যই খুঁজে পাবে কর্তৃপক্ষ। জহির রায়হানের লেখা মূল গল্পটি আজও রয়ে গেছে। প্রয়োজনে সেই গল্প অবলম্বনে আবার চিত্রনাট্য রচনা করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের মতো বিশাল ইতিহাস নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নেই। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নির্মাণ করে সেই অভাব দূর করা সম্ভব। সরকার যদি এর জন্য ন্যূনতম অনুদানের ব্যবস্থা করে তাহলে সুচন্দা নিজেই কাজটি শুরু করতে চান। বাস্তবায়ন করতে চান জহির রায়হানের স্বপ্ন।

সর্বশেষ খবর