বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্যান্ডসংগীত হারাচ্ছে সোনালি অতীত

আলী আফতাব

ব্যান্ডসংগীত হারাচ্ছে সোনালি অতীত

একটা সময় ছিল ফিতার ক্যাসেটের। সিডি-ডিভিডি, ইউটিউবের এই যুগের কিশোর-তরুণরা হয়তো জানেই না ফিতার ক্যাসেট বলে কিছু ছিল। এমনও সময় গেছে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা টিফিনের টাকা জমিয়ে রাখত নতুন ক্যাসেট কেনার জন্য। আরও দেখা গেছে, একটা ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ভক্তকে। কোথাও কোনো ব্যান্ডদল আসছে গান পরিবেশনের জন্য, শুনলেই চারদিকে হইহই পড়ে যেত। সে যে কী আলোড়ন- বোঝানো যাবে না। কিন্তু এখন এসব বিষয় যেন কেবলই সোনালি অতীত।

ব্যান্ডসংগীতের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল এবারের করোনাকাল। স্টেজশো আর টিভি লাইভ দিয়ে যতটুকু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল ব্যান্ডসংগীত, আজ যেন তাও হারাতে বসেছে। এভাবে চলতে থাকলে হারিয়ে যাবে ব্যান্ডসংগীতের ঐতিহ্য। এর কারণ কী? অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যান্ডশিল্পীদের একক ক্যারিয়ার এবং অ্যালবামের দিকে বেশি অমনোযোগী হওয়াই এর মূল কারণ। নিজের একক ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগী হতে গিয়ে ব্যান্ডের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েছেন ব্যান্ডের শিল্পীরা। এদিকে ব্যান্ডসংগীতে আলোড়ন তুলতে পারছে না নতুন কোনো ব্যান্ডদল। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে ব্যান্ডসংগীতের শুরু। আর নব্বইয়ের দশক ছিল ব্যান্ডসংগীতের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। এ সময় বাংলাদেশের কিছু কালজয়ী ব্যান্ডদলের প্রতিষ্ঠা, উত্তরণ ও উন্মেষ ঘটে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে। কিন্তু কী এমন হলো যে, ব্যান্ডের আধিপত্য কমে যাচ্ছে? সংগীতে যতটুকু দাপট তা ওই সলো ক্যারিয়ারেই। ব্যান্ডের গর্জন কোথায়? একটু পেছনে ফিরে তাকালে ব্যান্ডসংগীত শুধু ঢাকাকেন্দ্রিকই ছিল না, দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে উঠে এসেছে দেশসেরা ব্যান্ড। ঢাকা, চট্টগ্রামের পাশাপাশি ব্যান্ডসংগীত চর্চা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য বড় শহরেও, বিশেষ করে খুলনায়। বর্তমানে খোঁজ নিয়ে তেমন কোনো নতুন ব্যান্ডের দেখা মিলবে না।

‘শানাইয়ের সুর নিয়ে যাবে দূর একটু একটু করে তোমায়..., অথবা ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে..., অথবা ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে..., ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে..., ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে বন্ধু...। কী অপূর্ব এবং অসাধারণ গানের কথা।  সোলস, এলআরবি, মাইলস, ফিলিংস (বর্তমানে নগর বাউল), আর্ক, ফিডব্যাক, অবসকিওর, চাইম, ডিফারেন্ট টাচ, উইনিং, প্রমিথিউসসহ অনেক ব্যান্ড তাদের গানে তারুণ্যকে ভাসিয়ে নিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্যান্ডসংগীতে কেমন একটা অচলাবস্থা তৈরি হলো। বেশির ভাগ ভালো ব্যান্ডের মধ্যে দেখা দিল ভাঙন। বর্তমানে যে কয়টি ব্যান্ড কিছুটা হলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম দলছুট, চিরকুট ও জলের গান। ভেঙেচুরে ‘শিরোনামহীন’, ‘অর্থহীন’, ‘ব্ল্যাক’, ‘আর্টসেল’, ‘বাংলা’, ‘আর্কে’র অস্তিত্ব সংকটে।

বর্তমান ব্যস্ততা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আর্ক ব্যান্ডের প্রধান হাসান বলেন, ‘ভালো থাকার চেষ্টায় আছি। কিছু পুরনো গানের নতুন অ্যারেঞ্জমেন্ট করছি। তবে আমাদের ব্যান্ড প্র্যাকটিস চলছে নিয়মিত। এখানে কোনো ছাড় দিইনি। গানটাকেই যেহেতু জীবনের অঙ্গ হিসেবে ধারণ করেছি, তাই এর বাইরে তো কোনো কিছু ভাবতে পারিনি। ভাবতেও চাই না।’

তবে এর ভিতরে বরাবরের মতোই গুছিয়ে কাজ করা রকস্টারের শাফিন আহমেদ তাঁর নিজস্ব লেবেল কোম্পানি থেকে একাধিক গান রিলিজ দিয়েছেন। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক মানের ইনস্ট্রুমেন্টালের কাজ শেষ করলেন। শাফিন আহমেদের নির্দেশনায় এটি বাংলা মিউজিক এরিনাতে এক অনন্য কাজের স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। শাফিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা তো বসে থাকার মানুষ নই। ভিতরে যেহেতু সুর আছে, সৃজনীলতা আছে, তাই নিজের মতো করেই কাজ করে যাচ্ছি। নিয়মিতই দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে ছিলাম, আছি ও থাকব।’

এদিকে নগরবাউলের জেমস গত কয়েক মাসে একাধিক শোয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন। জেমস কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি একা নিজের ভিতরে আছি। কোনো কনসার্ট করিনি, করছিও না। কারণ আমাদের শোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল। কনসার্ট থেকে একজন দর্শকও যদি সংক্রমিত হয়, কে নেবে সেই অপবাদ। তাই নিজের মতো আছি। তবে ভ্যাকসিন চলে এসেছে। নিশ্চয় খুব শিগগিরই সব স্বাভাবিক হবে। আবারও মাঠে উল্লাস হবে।’ এরই মধ্যে নতুনদের মন রক্ষা করতে নিজেদের মতো করে গান চালিয়ে যাচ্ছে ব্যান্ডদল চিরকুট। গত বছরের শেষে ও নতুন বছরের বেশকিছু স্টেজশোতে অংশ নিয়েছে তারা। তার পাশাপাশি ‘জলের গান’ গেয়ে যাচ্ছে তাদের মতো করে। একে একে প্রকাশ করে যাচ্ছে তাদের নতুন নতুন গান। এছাড়া বর্তমানে কোনো ব্যান্ডের নামই তেমন একটা শোনা যায় না। কখনো কখনো হয়তো কোনো একটা গান হিট হয়, তারপর সবাই ভুলেও যায় গায়ক এবং ব্যান্ডের নাম। এছাড়া পুরনো ব্যান্ডগুলোর নেই নতুন কোনো গান। আর যে গানগুলো প্রকাশ হচ্ছে সেই গানগুলো পাচ্ছে না তেমন কোনো জনপ্রিয়তা। প্রযুক্তির কল্যাণ আর বস্তাপচা কথার বদৌলতে সস্তা দরের গান আর স্পন্সরদের খুশি করাই এখন ব্যান্ডগুলোর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আগে ব্যান্ডসংগীত কেবল প্রেম, ভালোবাসা, ভালো লাগার কথাই বলত না, সমাজসচেতনতার কথাও বলত। তারা কেন হারিয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর কি আমরা খুঁজেছি কখনো? ব্যান্ডসংগীত কি আবার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে না? তবে পাওয়ারসার্জ, আরবোভাইরাস, এভোয়েড রাফা, ওল্ড স্কুল, ছাতক, মিনেরেবার মতো নতুন ব্যান্ডগুলো নতুন আঙ্গিকে ব্যান্ডসংগীতের ধারা ক্রমবর্ধমান রাখতে পারছে না। এখন হয়তো পাড়ায় পাড়ায় ব্যান্ড নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকরা দুই-চারটি ব্যান্ড নেই। তবে একদম কিছুই যে নেই তা ভুল। তবে যা আছে তা তো সারা দেশে আলোড়ন তুলতে পারে না। পুরোটাই কি সিস্টেমের জন্য তারা আড়ালে? নাকি নিজেদের নেই স্বকীয় কোনো দক্ষতা? নিজেদের কণ্ঠ ও লেখনীর নেই জোর। ভালো কিছু হলে এখন তো ইন্টারনেটের যুগে ভাইরাল হওয়া আরও সহজ। ২০০০ সালের পর থেকে ব্যান্ডসংগীত পড়ে যায় অস্থিরতার মধ্যে। ক্যাসেটের যুগ থেকে সিডির যুগে প্রত্যাবর্তন। আর ইউটিউবের এই সময় এসে কোনো গানই যেন স্থায়ী হচ্ছে না শ্রোতাদের মনে। তবে নতুন সময়ে আবারও সচল হয়ে সংগীতের নিয়মিত পারফরম্যান্সে ফেরার দিনই যেন গুনছেন রকস্টার ও রকলাভারের শ্রোতা-দর্শক।

 

সর্বশেষ খবর