বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নাটকে উপেক্ষিত একুশ

স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের টিভি অঙ্গনে ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রচুর নাটক নির্মিত হয়েছে। তবে আশি-নব্বই দশকের পর একুশ নিয়ে নাটক নির্মাণ কমতে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে টিভি চ্যানেলে ভাষা আন্দোলনভিত্তিক নামমাত্র কিছু নাটক প্রচার হয়। কারণ এ বিষয় নিয়ে নির্মাণ কম। যদিও সাধারণ মানুষের মধ্যে একুশের চেতনা বেশি উজ্জীবিত থাকে। কিন্তু মানুষের সেই আবেগের কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারছে টিভি নাটক? লিখেছেন- পান্থ আফজাল

নাটকে উপেক্ষিত একুশ

আমাদের টিভি নাটকের রয়েছে সুন্দর সোনালি অতীত। একটা সময় এ দেশের টিভি নাটকের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। তখন বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল টিভি নাটক। নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। নাটক প্রচারের সময় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। নাটকের দর্শক ছিল অগণিত। ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো ন্যাশনাল প্যানাসনিকে চোখ আটকে থাকত দর্শকদের। মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখত সেসব নাটক ও তাদের প্রিয় অভিনয়শিল্পীদের। সে সময়কার নাটকের তালিকা করলে প্রথমেই চলে আসে- ‘সংশপ্তক’, সকাল-সন্ধ্যা, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকি জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘পারলে না রুমকী’, ‘ইতি আমার বোন’সহ আরও কত নাটক! ভাষা আন্দোলনভিত্তিক নাটক প্রচার হতো। তখনকার নাটকের সংলাপও মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি টিয়া পাখির মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল টিভি নাটকে। ‘বহুব্রীহি’ নাটকটি প্রচার হওয়ার পর বলতে গেলে রাজাকারদের প্রতি নতুন করে প্রবল ঘৃণা জন্ম হয়। নাটকটিতে যাঁরাই অভিনয় করেছিলেন, পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। সোনালি দিনের জনপ্রিয় নাটকের নামের তালিকার কথা উঠতেই প্রথমে জোরেশোরে ওঠে আসে ‘সংশপ্তক’র নাম। বিটিভির ইতিহাসে এই নাটকটির জনপ্রিয়তা ছিল শীর্ষে। এই নাটকে ফেরদৌসী মজুমদার ও হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের কথা এখনো মনে রেখেছেন অনেকে। হুমায়ুন ফরীদি এই নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে এবং ফেরদৌসী মজুমদার ‘হুরমতি’ চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় এসেছিলেন। এ ছাড়াও খলিলউল্লাহ খলিল ‘মিয়ার বেটা’ চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের কথা কি সেই সময়ের দর্শকরা ভুলতে পেরেছেন? মনে হয় ভুলতে পারেননি। ভুলে যাওয়াও সম্ভব নয়। নাটকটির নাট্যকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এটি প্রযোজনা করেছিলেন বরকত উল্লাহ। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে কতটা আপন হতে পারে তা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি দেখলেই টের পাওয়া যায়। বাকের ভাইয়ের যখন ফাঁসি হবে তখন এ দেশের শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল মিছিল করার জন্য, যাতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেওয়া হয়। এরপর ছিল ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক। ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ‘রূপনগর’ টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আরও একটি সফল, আলোচিত এবং জনপ্রিয় নাটক। ইমদাদুল হক মিলনের ‘বারো রকম মানুষ’ ধারাবাহিকটিও সে সময় দর্শকদের মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। নাটকটিতে সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনয় করেছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ও সে সময়ের নাটকগুলোর মধ্যে আলোচিত। ‘সকাল-সন্ধ্যা’ সে সময়ের আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে অন্যতম। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন বরকতউল্লাহ। প্যাকেজ নাটক প্রচার শুরু হওয়ার পর এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার পরও কিছু কিছু ধারাবাহিক নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে, সোনালি দিনের টিভি নাটকের কথা সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছেন দর্শকরা। এদিকে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে একুশ নিয়ে নাটক আজকাল তেমন চোখে পড়ে না টিভিতে। যদিও কিছু প্রচার হয়, তবে সেটা অপ্রতুল। মাঝে মাঝে প্রচার হয় বিকৃত ভাষার নাটক। একুশের নাটক নির্মাণে চ্যানেলগুলোর মধ্যে অর্থসংস্থানের বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। আর নাটকে সঠিক ভাষা ব্যবহারের জন্য কিন্তু অতিরিক্ত অর্থও খরচ করতে হয় না। এর জন্য দরকার আন্তরিক সদিচ্ছা। এ মাসটিতে দর্শক কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে একুশের চেতনা বেশি উজ্জীবিত থাকে। কিন্তু মানুষের সেই আবেগের কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারছে টিভি নাটক? অন্যদিকে বলা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে তেমন মৌলিক কোনো উল্লেখযোগ্য নাটক তৈরি হয়নি। যদিও প্রথমদিকে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে একুশ নিয়ে আমাদের নাট্যাঙ্গনে নেই উল্লেখযোগ্য নতুন কোনো শিল্পসৃষ্টি। এটি ভাষার জন্য প্রাণ বলি দান করা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বটে। এ দায় কার? তবে গত কয়েক বছরে উল্লেখ করার মতো নাটক বলতে জাহানারার একটি ভাই ছিল, যে গল্পটি বলা হয়নি, চশমা, বর্ণমালার মিছিল, পাগলা ঘণ্টা, শহীদ মিনার, আদর্শলিপি, যুদ্ধের ভাষা, ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, ভাষার আর্তনাদ, ঝুটুম পাখিসহ কিছু নাটক নির্মিত হয়েছে। মামুনুর রশীদ বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো নাটক এখনো তেমন করে রচিত হয়নি। যা হয়, তা দায়সারা। একুশ নিয়ে নাটক তৈরি হচ্ছে কম। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রচুর নাটক হওয়া উচিত ছিল।’ যদিও শুধু একুশ উপলক্ষে কিছু চ্যানেলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে নাটক তৈরি হয়। তবে তা নিতান্তই কম। বিটিভিসহ কিছু টিভি চ্যানেল অন্যান্য আয়োজনের পাশে দুই-একটি নাটক প্রচার করে থাকে। যদিও সেসব নাটকে ভাষা আন্দোলন কতটুকু তুলে ধরা হয়, তা সবাই জানে! অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ বলেন, ‘ভাষার জন্য এত ত্যাগ পৃথিবীর অন্য কোনো জাতিকে করতে হয়নি। কিন্তু এ ভাষাকে নিয়ে নাটক অনেক কম। আবার যেগুলো হচ্ছে, ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। প্রকৃত বাংলাভাষা যেন কেউ বিকৃত করতে না পারে এটাই চাওয়া।’ জাহিদ হাসান বলেন, ‘আগে একমাত্র টিভি চ্যানেল হিসেবে বিটিভিতে যে ভাষার ব্যবহার হতো সেটি সবাই ফলো করত। বাংলাভাষা অনেক বড় একটি বিষয়। ছোটখাটো বিষয়ের জন্য বাংলাভাষাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রচুর নাটক নির্মাণ দরকার।’ আনিসুর রহমান মিলন বলেন, ‘টিভি নাটকে বাংলাভাষার ব্যবহার নষ্ট হয়ে গেছে এখন থেকে আরও ১৫-১৬ বছর আগে। শুদ্ধ বাংলা বা প্রচলিত বাংলাভাষার নাটক প্রযোজন। এগুলো সবার ভাবা উচিত। আর একুশ নিয়ে নাটকের সংখ্যা অনেক কম। তাই বেশি বেশি নাটক তৈরি হওয়া উচিত।’

যে ভাষার ব্যবহারের জন্য রক্ত ঝরাতে হয়েছে সেই শুদ্ধ বাংলাভাষা আজ নাটকে অনেকটাই দায়সারাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে টিভি মাধ্যমে। এফএম রেডিগুলোর অবস্থা তো যাচ্ছেতাই! তাই দায়িত্ববোধের জায়গাটি যদি সবার থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো ভালো ভাষা আন্দোলন নিয়ে নাটক নির্মাণ সম্ভব।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর