শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নতুন নতুন প্রযোজনায় সরব নাট্যাঙ্গন

মোস্তফা মতিহার

নতুন নতুন প্রযোজনায় সরব নাট্যাঙ্গন

আক্রান্ত আর মৃত্যুর হার কমে সুস্থতার হার বাড়লেও এখনো শেষ হয়নি করোনাকাল। আর এই করোনাকে উপেক্ষা করে নতুনভাবে জেগে উঠেছে নাট্যাঙ্গন। দর্শক, শিল্পী ও কলাকুশলীদের পদচারণায় মুখরিত শিল্পকলা একাডেমি ও নাটক সরণিখ্যাত বেইলি রোডের মহিলা সমিতি। দীর্ঘ লকডাউন শেষে গত বছরের ২৮ আগস্ট মহিলা সমিতিতে মঞ্চায়ন হয় মোমেনা চৌধুরী অভিনীত একক নাটক ‘লাল জমিন’। এই নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নতুন করে নাট্যাঙ্গনের মানুষরা সাহসের ওপর ভর করে এগিয়ে যায়। এরপর ওই বছরের ২৩ অক্টোবর অর্ধেক আসন খালি রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাটক মঞ্চায়নের শর্তে শুধু শুক্র ও শনিবার নাটক মঞ্চায়নের জন্য শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন খুলে দেওয়া হয়। প্রথম ছয় মাস বিনা ভাড়ায় নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ পেয়ে পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর পাশাপাশি নতুন ও উদীয়মান দলগুলোও নতুন নতুন প্রযোজনার নাটক মঞ্চায়নে এগিয়ে আসে। এই ধারাবাহিকতায় সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে আরণ্যক মঞ্চে এনেছে দলটির নতুন প্রযোজনার নাটক ‘কহে ফেসবুক’, স্পর্ধা এনেছে ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’, পদাতিক নাট্য সংসদ এনেছে ‘পাকে বিপাকে’, প্রাঙ্গণেমোর এনেছে ‘মেজর’, ঢাকা থিয়েটার এনেছে নতুন নাটক ‘একটি মৌলিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’, অনুরাগ নাট্যদল এনেছে দলটির নতুন প্রযোজনার ভিন্নধর্মী গল্পের নাটক ‘অবজেকশন ওভাররুলড’, সংস্কার নাট্যদল এনেছে ‘গীতি চন্দ্রাবতী’, থিয়েটার ৫২ এনেছে ‘কালীদাস’, এম্পটি স্পেস থিয়েটার এনেছে ‘দ্য নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, শৌখিন নাট্যদল এনেছে ‘ধূম্রজ্বালা’, অনুস্বর এনেছে ‘মূল্য অমূল্য’,  নৈবেদ্য থিয়েটার এনেছে ‘প্রত্যাবৃতা’, এথিক এনেছে ‘আয়নাঘর’। নতুন এসব প্রযোজনার পাশাপাশি পুরনো প্রযোজনার নাটকগুলো মঞ্চায়ন হচ্ছে নিয়মিত। পুরনো নাটকগুলোর মধ্যে এই করোনাকালে পুরনো যে নাটকগুলো একাধিকবার মঞ্চায়ন হয়েছে এবং সামনেও মঞ্চে আসার সম্ভাবনা রয়েছে সেই নাটকগুলো হলো- লোক নাট্যদলের (সিদ্ধেশ্বরী) ‘কঞ্জুস’, ‘সোনাইমাধব’, প্রাঙ্গণেমোরের ‘হাছন জানের রাজা’, ‘আওরঙ্গজেব’, ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’, মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের ‘নীলাখ্যান’। নতুন বছরে প্রায় সব দলই নতুন প্রযোজনা নিয়ে মঞ্চে আসছে আর সেই লক্ষ্যে অনেক নাটকের দল নিয়মিত মহড়া করে যাচ্ছে এমনটি জানিয়েছে বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। করোনার এই সময় নতুন নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাট্যাঙ্গনকে চাঙা করার পর নাট্যকর্মীরাও চাঙা হয়ে উঠেছেন। আর নতুন নতুন নাটক মঞ্চায়নে বর্তমানে অন্য দলগুলো মহড়াকক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছে। সন্ধ্যায় শিল্পকলা

একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তন ও মহিলা সমিতির মিলনায়তনে সংলাপ আওড়ানোর উচ্ছ্বাস, সংগীতের সঙ্গে আলোক প্রক্ষেপণের নান্দনিকতায় নাট্যকর্মীদের ব্যস্ততা। আর বিকাল থেকে একাডেমির মহড়াকক্ষসহ রাজধানীর অন্যান্য স্থানের মহড়াকক্ষগুলোতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন নাট্যকর্মীরা। নাট্যাঙ্গন চাঙা হওয়ার বিষয়ে অভিনেত্রী ও নির্দেশক লাকী ইনাম বলেন, মঞ্চে নতুন নতুন নাটক আসছে, এটা থিয়েটারের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো দিক। তবে নাটক মঞ্চায়নের জন্য যে পরিমাণের মঞ্চ দরকার সে পরিমাণের মঞ্চ আমাদের  নেই। তাই আমি মনে করি নাটকের দল ও নাটকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মিলনায়তনের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হোক। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশানসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কয়েকটি মঞ্চ নির্মাণ করা হলে নাটকের বিকাশ আরও বেশি ঘটবে এবং দ্রুতই ঘটবে।

অভিনেতা ও নির্দেশক অনন্ত হীরা বলেন, কোনো প্রতিকূলতা ও দুর্যোগ সৃজনশীল কোনো শিল্পকর্মকে আটকিয়ে রাখতে পারে না। বৈশ্বিক দুর্যোগ চলমান করোনাকে উপেক্ষা করে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে নাট্যকর্মীরা নতুন করে জেগে উঠেছে। এই করোনার মধ্যে আটটি নাট্যদলের আটটি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। এটা নাট্যাঙ্গনের জন্য নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক। বিভিন্ন দল নতুন নতুন প্রযোজনা মঞ্চে এনে নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। যত বেশি নতুন নাটক মঞ্চে আসবে নাটকের চর্চা তত বেশি হবে। এতে করে নাটকের বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটবে। নাটক সমাজের দর্পণ। নাটকের মাধ্যমে নাট্যকর্মীরা সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরছে। আমি চাই নাটকের মঞ্চায়ন আরও বৃদ্ধি পাক। তবে নাটক মঞ্চায়নের জন্য যে পরিমাণ মিলনায়তন দরকার আমাদের সেই পরিমাণ মিলনায়তন নেই। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আরও কয়েকটি মঞ্চ নির্মাণ হলে নাটকের প্রসার আরও বেশি ঘটবে। বেশি বেশি করে নতুন নাটক নিয়ে সব দল এগিয়ে আসুক এটাই আমি চাই।

থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’র সম্পাদক পাভেল রহমান বলেন, মঞ্চে নতুন নাটক আসছে, এটা ইতিবাচক। কিন্তু শুধু নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাট্যচর্চার বিকাশ ঘটবে না। নতুন নাটকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় এখন আগের মতো অনেক নাট্যকর্মীই মনোযোগ দিতে পারছেন না। জীবিকার জন্য অন্য পেশায় কাজ করে সন্ধ্যায় ক্লান্তি নিয়ে মহড়ায় এসে থিয়েটারে সময় দিচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। কিন্তু থিয়েটারের মতো একটা পরিশ্রমী শিল্পমাধ্যম পার্টটাইম করার কাজ নয়। এখানে ফুলটাইম সময় দেওয়া জরুরি। এর জন্য সরকারের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। করোনা মহামারীতে অনেক নাট্যদলই বসে বসে মহড়াকক্ষের ভাড়া দিয়েছে। সরকার বিভিন্ন মাধ্যমে প্রণোদনা দিলেও সংস্কৃতিকর্মীদের নামমাত্র সহায়তা দিয়েছে। সংস্কৃতি খাতে সরকার নতুন বছরে আরও বেশি সহায়ক হবে বলেই প্রত্যাশা করি। এ বছর নাট্যাঙ্গনে নতুন নাটক মঞ্চে আসবে, পাশাপাশি নাট্যকর্মীদের সৃজনশীল ও মননশীল বিকাশের জন্য অভ্যন্তরীণ কর্মশালা, পাঠচক্র অব্যাহত থাকুক এবং সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কৃতিচর্চায় সহায়ক হোক।

 

সর্বশেষ খবর