রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘরের ছবিতে ঘরের নায়িকা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঘরের ছবিতে ঘরের নায়িকা

অপু - শাকিব - বুবলী

এক ছিলেন রাজা আরেক ছিলেন রানী, রাজার সর্বনাশ, রানী গেলেন বনবাস’; মূল গল্পে পরে আসা যাক। প্রফেশনালিজম ও পার্সোনালিজম দুটো আলাদা জিনিস। আবেগের টানে দুটোকে এক করে ফেলা মানে দিন শেষে বিপত্তিতে পড়া। সবার দিন সবসময় একরকম যায় না। আজকের রঙিন দুনিয়া মুহূর্তেই সাদা-কালো হয়ে যেতে পারে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি ভয়ংকর বাস্তব। অনেকেই ঝলমলে দুনিয়া থেকে একসময় অনিশ্চিত জীবনে ছিটকে পড়েন। আশির দশকের একটি ঘটনা দিয়েই শুরু করি। তখনকার দাপুটে চলচ্চিত্র প্রযোজকদের মধ্যে ফারুক ঠাকুর অন্যতম। তার ছবিতে কাজ করতে নায়িকারা মুখিয়ে থাকতেন। সে সময় মফস্বল থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে আসেন বনশ্রী নামে একটি মেয়ে। যে কোনোভাবে বনশ্রী পৌঁছে যান ফারুক ঠাকুরের ঘরে। বনশ্রীকে দেখে মনে ধরে ঠাকুরের। দেরি না করে লুফে নেন তাকে। সিদ্ধান্ত নেন তার সব ছবির নায়িকা হবেন বনশ্রী। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। এ কারণে মেয়েটিকে একটি শর্ত দেন তিনি। শর্তটি হলো তার প্রযোজনা সংস্থার বাইরে অন্য কারও ছবিতে কাজ করতে পারবেন না বনশ্রী। অভাব অনটন থেকে নিস্তার পেতে আর রঙিন দুনিয়ার ঝলমলে আলোর মোহে কালবিলম্ব না করে ঠাকুরের কথায় রাজি হয়ে যান বনশ্রী। এরপর মেয়েটিকে ফারুক ঠাকুর শুধু নিজের ছবিতে অভিনয় করিয়ে ক্ষান্ত হননি। তাকে মোহাম্মদপুরে আলিশান ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, সোনা-রুপা অর্থবিত্তের শান শওকতে ভরিয়ে দেন। ওই সময় অনেক নির্মাতা বনশ্রীকে নিয়ে কাজ করতে চাইলেও ফারুক ঠাকুরের প্রতি ভালোবাসা আর আস্থায় টইটুম্বুর এই নায়িকা কাউকে পাত্তা দেননি তখন। এভাবে অর্থ-বৈভবে দিন কাটতে থাকে নায়িকা বনশ্রীর। কিন্তু সুখ তার কপালে বেশি দিন সইল না। ঘটনাচক্রে একটি মামলায় জড়িয়ে আত্মগোপনে চলে যান ফারুক ঠাকুর। ধীরে ধীরে ধস নামতে থাকে বনশ্রীর বিত্ত-বৈভবের দুর্গে। ফারুক ঠাকুরের ছবি প্রযোজনা বন্ধ। বনশ্রীর হাতে কাজ নেই। একসময় যেসব নির্মাতাকে দুয়ার থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বনশ্রী এবার তাদের দরজায় তার কড়া নাড়া শুরু। কিন্তু আগের অপমানের কথা মনে করে কেউ তাকে আর কাজ দেননি। একসময় রাজমহল থেকে ফুটপাথে ছিটকে পড়লেন বনশ্রী। শুরু হলো অভাবের সঙ্গে তার চরম যুদ্ধ। মোহাম্মদপুরের একটি বস্তিতে মাথা গুঁজলেও ঘরভাড়া দিতে পারেন না, দুমুঠো অন্নও মুখে তোলার সাধ্য নেই। একসময় নানা পণ্যসামগ্রী রাস্তায় বিক্রি করেও অন্ন সংস্থান হচ্ছিল না তার। বাধ্য হয়ে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। বনশ্রীর জীবনের এই উত্থান-পতনের গল্প তার নিজের মুখেই বর্ণিত। অভিনয় করতে এসে এক ঘরে বন্দী হওয়ার জন্য নিজেকে দায়ী করে অশ্রুপাত করে যাচ্ছেন এখনো বনশ্রী। এই তো গেল বনশ্রীর জীবনের আলো-আঁধারের খেলার গল্প। চলচ্চিত্র জগতে এমন গল্প আরও আছে।

চিত্রনায়িকা রেসিকে চলচ্চিত্রে আনেন চিত্রপরিচালক বুলবুল জিলানী। জিলানীর ‘নীল আঁচল’ ছবিটি দিয়ে চিত্রজগতে রেসির অভিষেক। এই ছবির নায়কও ছিলেন জিলানী। এই নির্মাতাও রেসিকে তার ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেন। রুপালি জগতে নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রেসিও তাতে সম্মত। কিন্তু দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, মাস বছর গড়ায়। ‘নীল আঁচল’ আর মুক্তি পায় না। এমনকি জিলানী নতুন কোনো ছবিও আর নির্মাণ করছেন না। শুধুই জিলানীর ঘরে বন্দী হয়ে থাকা তার। এভাবে আর কত। হতাশা বাসা বাঁধতে থাকে রেসির মনে। একসময় রেসির প্রেমে পড়া আরেক উঠতি মডেল-নায়ক তাকে জিলানীর ঘর থেকে বের করে নিয়ে যান। দু-একটি টিভিসি করার সুযোগ করে দেন। তারপর ওই নায়কের শুধু প্রেমে আর মন ভরে না রেসির। তিনি ছবির কাজ চান। তখন ডিপজলের ঘর থেকে প্রচুর ছবি নির্মাণ হচ্ছিল। সব ছবিই হিট। সেই মডেল তারকা নায়িকা বানাতে ডিপজলের কাছে নিয়ে যান রেসিকে। ডিপজলও প্রথম দেখায় পছন্দ করে ফেলেন রেসিকে। তবে শর্ত একটাই। অন্য কোনো ঘরের কাজ করতে পারবেন না রেসি। নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রেসি তাতেই রাজি। কথিত আছে একের পর এক হিট ছবির সঙ্গে সঙ্গে রেসিকে ফ্ল্যাট বাড়ি গাড়ি সোনা-রুপায় ভরিয়ে দেন ডিপজল। কিন্তু সেই পুরনো প্রবাদ ‘দিন সবসময় সমান যায় না কারও।’ যে কোনো কারণে একসময় ডিপজল-রেসির সম্পর্কে চির ধরে। বুদ্ধিমতী রেসি বুঝতে পারেন এতদিন এক ঘরে বন্দী হয়ে থাকা তাকে অন্য কেউ তেমনভাবে ছবিতে সুযোগ দেবেন না। দ্রুত এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে সংসারী হন তিনি। সুখেই আছেন এখন। এর পরের গল্পের নায়ক-নায়িকা বহুল আলোচিত শাকিব খান-অপু বিশ্বাস জুটি। শাকিব চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৯৯ সালে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একসময় ঢাকাই ছবির শীর্ষ নায়কের আসনটি নিজের করে নেন। তার এমন সাফল্যে অনেক নায়িকাই তার ঘরে ওঠার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সবাইকে হারিয়ে ২০০৬ সালে ‘কোটি টাকার কাবিন’ ছবিতে শাকিবের সঙ্গে জুটি বাঁধা এই ছবির মাধ্যমে নায়িকা হয়ে অভিষেক ঘটা তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারী অপু বিশ্বাস যে কোনোভাবেই হোক শাকিবের মন কেড়ে নেন। অল্প সময়ে শাকিবও তার প্রেমের জাদুতে বুঁদ হয়ে যান। ২০০৮ সালে গোপনে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তারা। এরপর থেকে নির্মাতাদের কাছে শাকিবের একটিই শর্ত, তাকে নায়ক করতে হলে অবশ্যই নায়িকা থাকতে হবে অপু। নির্মাতাও শাকিবকে পেতে তার শর্ত মেনে নিতেন। এমনও ঘটনা ঘটেছে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ ছবিতে নির্মাতা বিদ্যা সিনহা মিমকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেও শাকিবের আপত্তির কারণে শেষমেশ বিদ্যাকে বাদ দিয়ে অপুকে নায়িকা করতে বাধ্য হন। এভাবে শাকিবের কারণেই অপু দ্রুত ‘জনপ্রিয় নায়িকা’র তকমা পেয়ে যান। শাকিব খান প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘হিরো দ্য সুপারস্টার’ এর প্রধান নায়িকাও ছিলেন অপু। একসময় নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় শাকিব-অপু সম্পর্কের অবসান ঘটলে অপু ছবি শূন্যতার কবলে পড়েন। এরপর শুরু হয় শাকিব-বুবলী অধ্যায়। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের খবর পড়য়া মেয়ে শবনম বুবলীকে দেখে মুগ্ধ হন শাকিব। শুরু হয় তার সঙ্গে জুটি বেঁধে ছবি করা। শাকিব প্রযোজিত ছবির নায়িকাও থাকলেন বুবলী। সর্বশেষ সৈকত নাসির পরিচালিত ‘ক্যাসিনো’ ছবিতে নায়ক নিরবের সঙ্গে জুটি বাঁধার পূর্ব পর্যন্ত বুবলী ছিলেন শাকিবের ছবির নায়িকা। চলচ্চিত্রকার অনন্ত জলিল ২০১০ সালে বড় পর্দায় আসেন ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ ছবিটি নিয়ে। এ ছবির প্রধান নায়িকা ছিলেন বর্ষা। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একে অপরের প্রেমে পড়েন। তারপর বিয়ে। অনন্তর ছবি ছাড়া বর্ষাকে অন্য কোনো নির্মাতার ছবি বা নায়কের সঙ্গে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। এমনকি শুধু ‘স্পিড’ ছবিটি ছাড়া অনন্তও বর্ষা ছাড়া আর কারও নায়ক হননি। এভাবে চিত্রজগতের এক ঘরে বন্দী অনেক নায়িকার কথাই আলোচনায় আসে। যেমন ববি একসময় ছিলেন শুধুই ইফতেখার চৌধুরী পরিচালিত ছবির নায়িকা। ভাবনা এখনো নির্মাতা অনিমেষ আইচের ঘরে বন্দী। শেষ কথা হলো অনেকে এক ঘরে বন্দী থেকে হয়তো সুখ স্বপ্ন চিরস্থায়ী করে নিয়েছেন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে হিতে বিপরীত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর