সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

যথাযথ মূল্যায়ন চান নৃত্যশিল্পীরা

যথাযথ মূল্যায়ন চান নৃত্যশিল্পীরা

দেশে নৃত্যচর্চার প্রচার-প্রসার বাড়লেও এ শিল্পে যেমন রয়েছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তেমনি হচ্ছে না নৃত্যশিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন। যোগ্য নৃত্যশিল্পীরা পাচ্ছেন না তাঁদের কাজের স্বীকৃতি। নৃত্যশিল্পীরা চান তাঁদের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন। এ বিষয়ে কিছু গুণী নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

লুবনা মারিয়াম

সব পদকই রাজনৈতিক। তাই পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। মূল্যায়ন না হওয়াকে আমি উপেক্ষিত মনেও করি না। আর নাচের ব্যাপারে এখনো কেউ লুবনা মারিয়ামকে অতিক্রম করতে পারেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে আমি কতটুকু গুরুত্ব পেলাম কি পেলাম না, তা নিয়ে ভাবী না। বিশ্বের সবাই  তো আমাদের চেনে, সেটাই বড় পাওয়া, বড় স্বীকৃতি। যে কোনো স্বীকৃতির তো কোনো না কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে। কারণ, সরকারি সব স্বীকৃতিই রাজনৈতিক। স্বীকৃতিকে আমি সম্মান দিই। আর আমি বামপন্থি। তবে যে অঙ্গনে আমার স্বীকৃতির প্রয়োজন, তা অনেক পেয়েছি। তাই মূল্যায়ন নিয়ে ভাবী না।

 

মিনু হক

মূল্যায়ন না করলে কি করার আছে! হাটে-ঘাটে তো সব সময় ঠিকই শিল্পীদের নাচতে হয়। নাচ ছাড়া কী হয় কোনো অনুষ্ঠান? হয় না। তবে কেন যথাযথ মূল্যায়ন করছে নাম, এটা তো অন্যায়। এটা দুঃখজনক। ২০১৯-এ একুশে পদক দেয়নি, আবার ২০২০-এ দিয়েছে। এটা তো অনিয়মিতভাবেই চলছে। এটা অপমানজনক। এ বিষয়ে আমি চিঠি দেব কালচারাল মিনিস্ট্রি বরাবর। তবে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। এখন বিস্তারিত কিছু বলাও ঠিক হবে না। আমরা সবাই মিলে বসব, তারপর কি হয় জানাতে পারব। এবং  সে হিসেবে পদক্ষেপও নিতে পারব।   

 

শিবলী মোহাম্মদ

দেশের জন্য নৃত্যশিল্পীদের অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় নৃত্যশিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। প্রতি বছর বিভিন্ন সেক্টরে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক দেওয়া হয়। কিন্তু নৃত্যশিল্পীদের দেওয়া হয় অনিয়মিত। এটা খুবই দুঃখজনক। এই শিল্পে যোগ্য লোক কী কেউ নেই? আমার জানা তো অনেক প্রবীণ  যোগ্য নৃত্যশিল্পী রয়েছেন। আমাদের আসলে রিসার্চের অভাব, কে যোগ্য আর কে অযোগ্য! যারা নাচ ছাড়া কিছুই ভাবেনি সারা জীবন, নাচকে করেছে জনপ্রিয়- তাঁদের কেন যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না! ২১ জনের মধ্যে একটা সেক্টর থেকে তো দুই-তিনজনও পদক পায়। তবে কেন নৃত্যশিল্পীরা অনিয়মিত পাবে? নৃত্যশিল্পীরা তো সবসময়ই অবহেলিত। জীবিত অবস্থায় স্বীকৃতি না পেয়ে মরণোত্তর পেয়ে কী লাভ একজন নৃত্যশিল্পীর! অন্যদিকে এ দেশের মিডিয়া প্রকৃত নৃত্যশিল্পীদের কভারেজ কম দেয়, অগ্রাধিকার কম দেওয়া হয়। চ্যানেলে অনেক কাজ হয়, শিল্পী তৈরি হয়, কোরিওগ্রাফার আছে অনেক, কিন্তু রিয়েল শিল্পীকে প্রায়োরিটি কতজন দেয়? টিভি মিডিয়া সব নন-ড্যান্সারকে নিয়ে কাজ করছে। যেখানে প্রকৃত নৃত্যশিল্পীরা উপেক্ষিত। কেন? এসব ঠিক না হলে নৃত্যের প্রসার ব্যাহত হবেই।

 

শামীম আরা নীপা

আমাদের তো সবসময়ই নাচের ব্যাপক কাজ হয়। আর দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে ড্যান্স একটা বড় ফ্যাক্টর। নাচ, গান ও যন্ত্র- এই তিনটি দেশকে রিপ্রেজেন্ট করে। যে কোনো ইভেন্টই নাচ ছাড়া হয় না। কিন্তু এই শিল্পের যথাযথ মূল্যায়ন কী হচ্ছে? একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয় প্রতি বছর। যেখানে সব সেক্টরের শিল্পীই নিয়মিত স্বীকৃতি পান, শুধু নৃত্যশিল্পীরা অনিয়মিত পান।  কেন? দেশে কি যোগ্য নৃত্যশিল্পী নেই? নাকি তাঁরা যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে অপারগ? এটা অন্যায়। ভাবলেই অসহায় লাগে। অবদানের অনেক ব্যাপকতা আছে। নৃত্যশিল্পী হিসেবে নয়; দেশের কর্মী হিসেবে দেশ যদি কোনোভাবে উপকৃত হয়, তাকে মূল্যায়ন করতেই হবে। যোগ্য ব্যক্তিই যেন মূল্যায়ন পান, সেটাই তো চাওয়া। আর কেউ যদি জীবদ্দশায় তাঁর কাজের মূল্যায়ন না পায়, মরণের পরে স্বীকৃতি অর্থহীন। যাঁরা সত্যিকার অর্থে কাজ করছেন, তাঁদের খুঁজে বের করা দরকার। অন্যদিকে প্রাইভেট চ্যানেলগুলো নৃত্যশিল্প বিকাশে নজর কম দিচ্ছে। যাঁরা প্রকৃত নৃত্যশিল্পী বা যাঁরা শুদ্ধ নৃত্যচর্চা করেন, চ্যানেলগুলো তাঁদের ব্যাপারে খুবই উদাসীন। আমার কাছে খুবই দুঃখ লাগে, রিয়েল ড্যান্সাররা যখন নন-ড্যান্সারদের পেছনে কোনো নাচের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? প্রকৃত ড্যান্সাররা বারবার অবহেলিত হচ্ছেন। এটাকে কীভাবে তাঁরা অসম্মান করে?

 

ওয়ার্দা রিহাব

যথাযথ মূল্যায়ন তো কখনোই হয়নি, এখনো হচ্ছে না। প্রতি বছর একুশে পদক প্রতিটি সেক্টর থেকেই পেয়ে থাকে। তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু গ্যাপ দিয়ে দিয়ে নৃত্যশিল্পীদের যে একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে অনেক অভিমান রয়েছে। এ বছর একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় কোনো নৃত্যশিল্পীর নাম খুঁজে পেলাম না। আসলেই কি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নৃত্যশিল্পীদের তেমন কোনো অবদান নেই? করোনাময় সময়ও নৃত্যশিল্পীরা একনাগারে নৃত্যচর্চা, নৃত্য শো করে গেছেন। আমাদের তো অনেক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন এই সেক্টরে। তাঁদের কেন দেওয়া হচ্ছে না? এটা প্রশ্নাতীত। পদক কমিটি কি যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পায় না? নাকি সদ্দিচ্ছার অভাব। তাঁরা যে যোগ্য নৃত্যশিল্পীকে খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা তাঁদের ব্যর্থতা।

আনিসুল ইসলাম হিরু       

মূল্যায়ন কোথায় হচ্ছে? নৃত্যশিল্পীদের প্রপার মূল্যায়ন হচ্ছে না বিভিন্ন কারণে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কম, টিভি চ্যানেল আর করপোরেট স্থানে নন-ড্যান্সারদের দিয়ে উৎসবভিত্তিক নাচ, ইভেন্ট হচ্ছে, যা ভীষণ মানহীন। পুরোটাই বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা থেকে হচ্ছে। সেখানে মেইনস্ট্রিমের কেউ নেই। নৃত্য মাধ্যমে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফিউশন, কনটেম্পোরারি নাচের নামে যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়ার মতো নয়! আর স্বীকৃতি তো তেমন করে নেই। কেমন করে নৃত্যশিল্পকে মূল্যায়ন করা যায়, তা নিয়ে কেউ ভাবে না। ড্যান্স হলো ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ। বাইরে কিন্তু নাচকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে একেবারেই নেই। নতুন শিল্পীরা উৎসাহ পাবে কীভাবে? প্রথম থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পীদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক কিংবা বাংলা একাডেমি পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে নাকি যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর! দেশে অনেক যোগ্য প্রবীণ নৃত্যশিল্পী রয়েছেন। মরণোত্তর পদক পেয়ে কি হবে? তাই আমি মনে করি, সব সেক্টরেই নৃত্যশিল্পীদের মূল্যায়ন করা উচিত। আমরা যাঁরা শুদ্ধ নৃত্যচর্চা করি, তাঁদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে বসা উচিত। নৃত্যশিল্পী সংস্থা নামে একটি সংগঠন আছে, তার ব্যানারে এসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

 

 লায়লা হাসান

বাংলাদেশে নৃত্যশিল্প আগের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। এটা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। কিন্তু এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বড় সমস্যা পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। তেমন করে নৃত্যশিল্পীরা পাচ্ছেন না স্বীকৃতি। এদিকে আমাদের জন্য কোনো নিজস্ব মিলনায়তন ও মহড়াকক্ষ নেই। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তন থাকলেও সেটি আসলে নৃত্য প্রদর্শনীর উপযোগী নয়। সব ক্ষেত্রেই নৃত্যশিল্পীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।

 

মুনমুন আহমেদ

সার্বিক অবস্থাটা আর কি বলব! আসলে কিছু আছে সিরিয়াস ড্যান্সার, বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করছেন, শুদ্ধ নৃত্যচর্চা করছেন। আর কিছু আছেন সস্তা ড্যান্সার, যাঁদের বলা হয় নন-ড্যান্সার। নিয়মের ঠিক নেই, কি কনটেম্পোরারি, কি ফিউশন- কিছুই তেমন করে বোঝা যায় না। এটা নৃত্যশিল্পের জন্য ক্ষতি হচ্ছে। চ্যানেল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সস্তা, সহজ শিল্পীদের ব্যবহার করছে। যাকে বলব পোশাকি নাচ। চ্যানেলের উচিত যাঁরা নৃত্যশিল্পকে ধারণ করেন, শুদ্ধ নৃত্যচর্চা করেন বা সাধনা করেন তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া। মঞ্চের নাচকে আরও পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার। সত্যিকার নৃত্যশিল্পীরা নৃত্যশিল্প বিকাশে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও আমাদের নাচের তেমন করে মূল্যায়ন নেই। স্বীকৃতি তেমন করে নেই। নৃত্যশিল্পীরা সবক্ষেত্রেই অবহেলিত। এটা খুবই হতাশাজনক। 

সর্বশেষ খবর