শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকার ছবিতে বিদেশি শিল্পীর হিড়িক

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকার ছবিতে বিদেশি শিল্পীর হিড়িক

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিলেন, দেশীয় অনেক শিল্পী ও কলাকুশলী বেকার রয়েছেন ছবির অভাবে। কিছু নির্মাতা বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সেদিকে দৃষ্টি নেই। তাঁরা বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়েই কাজ করতে বেশি আগ্রহ দেখান। অবস্থাটা এমন, ‘বিদেশি শিল্পী নিলেই তাঁর ছবি হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক মানের এবং সেই নির্মাতাও হয়ে যাবেন হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা স্পিলবার্গ বা জন ক্যামেরুন। দুঃখ একটাই, অনেকে কেন বুঝতে চান না, ছবি চলে গল্প আর নির্মাণের জোরে। এরপর আসে শিল্পীর বিষয়টি। আমাদের দেশে শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর কোনো অভাব নেই। তারপরও তাঁদের অবজ্ঞা করে অনেকে ছুটছেন বিদেশি শিল্পীদের পেছনে। এটি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিবিরুদ্ধ কাজ। যৌথ প্রযোজনার বিষয়টি ভিন্ন। এক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালায় উল্লেখ আছে উভয় দেশ থেকে অর্ধেক করে শিল্পী ও কলাকুশলী নিতে হবে।

তবে নির্মাতাদের কথায় এক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যের নীতিমালা থাকা দরকার। কারণ সরকার যখন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংশোধন করে এতে নতুন একটি শর্ত যুক্ত করে দেয় তখনই বাধে বিপত্তি। এই শর্তের ঙ এর ০২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সাধারণভাবে যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পী এবং মুখ্য কারিগরি কর্মীসহ শিল্পী ও কলাকুশলী সমানুপাতিক হারে নিয়োগের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’ প্রযোজক সমিতির কর্মকর্তা ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলীমউল্লাহ খোকন উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর কোথাও যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় এমন বাধাধরা নিয়ম নেই। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হয় তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে মানে দুই দেশের নির্মাতারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শিল্পী ও কলাকুশলী নির্ধারণ করে নেন। ওই সব দেশের সরকার বলছে, তাদের কাছে শিল্পী নয়, বিনিয়োগটাই মুখ্য। অথচ আমাদের দেশে ২০১২ সালের নীতিমালায়ও অন্য দেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে কাজ করে আসছিলাম। আমরা আমাদের দেশের শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রাধান্য দিয়ে আসছিলাম।

কিন্তু ২০১৭ সালের নীতিমালা এক্ষেত্রে বড় মাপের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের পর থেকে আর যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ হচ্ছে না বলেই চলে। সিনিয়র নির্মাতাদের কথায় নীতিমালা এমনভাবে তৈরি হওয়া উচিত যাতে  কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যৌথ নির্মাণ বা এক দেশের শিল্পী আরেক  দেশের ছবিতে কাজ করবেন এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই বলে কারও অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে তা কখনো কাম্য হতে পারে না। ঢাকাই ছবির মন্দা সময় চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এর ফলে স্বল্প হারে ছবি নির্মাণের কারণে বেকারত্বের কবলে পড়ে প্রচুর শিল্পী ও কলাকুশলী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিতেও নেমে পড়েছেন। এই বিষয়টি বিচেনায় এনে মানবিক কারণে হলেও সরকারকে ২০১৭ সালের যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার ঙ এর ২ ধারা বাতিল বা শিথিল করা দরকার। অন্যদিকে নির্মাতাদেরও

দেশীয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছবির নায়ক-নায়িকা হিসেবে বিদেশি তারকাদের দিকে ঝুঁকছে, চমক রাখার প্রত্যাশায়। এটি আসলে চমক নয়, স্ববিরোধিতার নামান্তর মাত্র। বলছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক-গবেষক অনুপম হায়াৎ। প্রায়ই অনেক নির্মাতা ঘটা করে ঘোষণা দেন, ‘আমার ছবির নায়ক, নায়িকা বা খলনায়ক হবেন বিদেশের অমুক শিল্পী। এ কথা শোনার পর এ দেশের শিল্পী ও কলাকুশলীরা চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েন।। তাঁদের কথায় ছবির অভাবে দেশীয় শিল্পীরা যখন বেকার তখন বিদেশি শিল্পীদের এনে কাজ করানো মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ঢাকাই ছবিতে কলকাতার বা অন্য দেশের শিল্পীদের নিয়ে স্বাধীনতার পর  থেকেই কাজ চলছে। শিল্পীরা বলছেন, তখন প্রচুর ছবি নির্মাণ হতো ঢালিউডে। শিডিউল পাওয়া যেত না শিল্পীদের। তাই এখনকার  প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। এখন এ দেশের শিল্পীদের আগে কাজ দিয়ে বাঁচাতে হবে। বলেছেন চলচ্চিত্রকার সুচন্দাসহ অনেকে। ২০১২ সালে নির্মাতা অনন্য মামুন যৌথ প্রযোজনায় কলকাতার সঙ্গে নির্মাণ করেন ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিটি। ওই সময় যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় শিল্পী ও কলাকুশলীর বিষয়ে সমানুপাতিক হারের শর্ত ছিল না। এই সুযোগের অপব্যবহার করে তখন ওই নির্মাতা বাংলাদেশ থেকে নামেমাত্র একজন শিল্পী মিশা সওদাগরকে নেন ছবিটিতে। বাকি সবাই ছিলেন কলকাতার। ছবিটির প্রধান দুই অভিনয়শিল্পীই ছিলেন কলকাতার। শুভশ্রী ও অংকুশ। এ নিয়ে তখন দেশীয় চলচ্চিত্রকাররা নির্মাতা অনন্য মামুনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। গত কয়েক বছরে ঢাকায় যৌথ বা একক প্রযোজনার হাত ধরে ঋতুপর্ণা ছাড়াও কলকাতার যেসব নায়িকা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন-শুভশ্রী (আমি শুধু চেয়েছি তোমায়, প্রেম কী বুঝিনি, নবাব), পাওলি দাম (সত্তা), শ্রাবন্তী (শিকারি, নবাব, চালবাজ, যদি একদিন), প্রিয়াঙ্কা সরকার (হৃদয়জুড়ে)। এখন পর্যন্ত বিদেশি শিল্পী যাঁরা ঢাকার ছবিতে কাজ করেছেন তাঁদের তালিকা খুব একটা সংক্ষিপ্ত নয়। এসব শিল্পীর মধ্যে রয়েছেন- সোমা মুখার্জি, শতাব্দী রায়, বনশ্রী, ঝুমুর গাঙ্গুলী, জয়শ্রী কবির, সুনেত্রা,  দেবশ্রী, মুনমুন, সন্ধ্যা রায়, আলপনা গোস্বামী, ইন্দ্রানী হালদার, শাবানা আজমী, জয়াপ্রদা, মমতা কুলকার্নি, ভাগ্যশ্রী, নীলম, আয়শা জুলখা, মনিকা দেবী, প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী, রাবিনা, মিনা, শিবানী, ঋতুপর্ণা, রচনা ব্যানার্জি, শ্রীলেখা মিত্র, মাহিমা, রিংকু ঘোষ, মিত্র যোশী, মধুমিতা, প্রিয়া, রিয়া সেন, রাইমা সেন, রাভিনা, ভিক্টর ব্যানার্জি, আইয়ুব খান, চাংকি পান্ডে, নাদিম, শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, রাজ বাব্বর, বাবরা শরীফ, ফয়সাল, পারভীন ববি, মিঠুন চক্রবর্তী, রঞ্জিত মল্লিক, আশীষ বিদ্যার্থী, রজতাভ দত্ত, প্রসেনজিৎ, জিৎ, অংকুশ, সোহম, ওম, হিরণ, পরমব্রত, ইন্দ্রনীল, স্বস্তিকা, স্নেহা উল্লালসহ আরও অনেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিনিয়র নির্মাতা বলছেন, দেশীয় চলচ্চিত্রের বাজার বিদেশে সম্প্রসারণের নামে  যৌথ ছবি বা স্থানীয় ছবিতে ভারতীয় শিল্পী এনে ফায়দা লুটছে একশ্রেণির অসাধু নির্মাতা-প্রযোজক। বিনোদনের আড়ালে সাদা হচ্ছে কালো টাকা। ভিনদেশি শিল্পীরা দেশের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে। এসব অসাধু কর্মকান্ডের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দেশীয় শিল্পীদের ক্যারিয়ার অনেক আগেই হুমকির মুখে পড়েছে। সিনিয়র নির্মাতারা বলছেন, দেশীয় চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকটের মিথ্যা অজুহাত  দেখিয়ে অনেকে বিদেশি শিল্পী এনে এখানে কাজ করাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, বেশির ভাগ বিদেশি শিল্পী ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই এখানে কাজ করছেন। অনেকের কথায় শুধু অভিনয়শিল্পী নয়, বিদেশি নির্মাতা, কণ্ঠশিল্পী, ফাইট ও মিউজিক ডিরেক্টরসহ নানা কলাকুশলী কাজ করছেন ঢাকার ছবিতে। এতে  বেকার হয়ে পড়ছেন স্থানীয় সংশ্লিষ্টরা। হুমকির মুখে পড়েছেন দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্প, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।

সর্বশেষ খবর