বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত দেশের খলনায়ক

আলাউদ্দীন মাজিদ

 চলচ্চিত্রে উপেক্ষিত দেশের খলনায়ক

ঢাকাই ছবিতে এখন দেশীয় খলনায়করা উপেক্ষিত। মিশা সওদাগর, ড্যানি সিডাক, ডন, শতাব্দী ওয়াদুদ, ডিপজলসহ বর্তমান সময়ের তাসকিন, শিমুল খান, রাশেদ মামুন অপু, আশীষ খন্দকার, এল আর খান সীমান্ত, শাহেদ আলী, ফারহান রিও-এর মতো শক্তিমান খলনায়ক থাকলেও দেশীয় নির্মাতারা ঝুঁকছেন বিদেশি খলনায়কদের দিকে। বলিউডের আশীষ বিদ্যার্থী, টালিগঞ্জের রজতাভ দত্তসহ অনেক খলনায়ক ঢাকার ছবিতে অভিনয় করলেও দর্শকমনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেননি। অথচ ঢাকার ছবিতে একজন ‘মিশা সওদাগর’ থাকলেই দর্শক বার বার ছুটে যান সিনেমা হলে। ‘ঢাকা অ্যাটক’ ছবি দিয়ে নতুন খলনায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া তাসকিনেরও রয়েছে দর্শকপ্রিয়তা। সম্প্রতি চলচ্চিত্রকার অনন্ত জলিল তাঁর নতুন ছবি ‘নেত্রী’র জন্য ঘোষণা দিলেন বেশ কজন বিদেশি খলনায়কের নাম। তাঁরা হলেন- দক্ষিণ ভারতের কবির দুহান সিং,   ভোজপুরী অভিনেতা রবি কিষান এবং প্রদীপ রাওয়াত। অনেক নির্মাতার এমন বিদেশি খলনায়কপ্রীতিতে চলচ্চিত্রের মানুষ বলছে এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ছবির অভাবে দেশীয় শিল্পীরা বলতে গেলে প্রায় বেকার। এ অবস্থায় বিদেশি শিল্পী এনে কাজ করানো মানে দেশীয় শিল্পীদের জীবন ও পেশাকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়। এটি কখনো কাম্য হতে পারে না।
চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া এ দেশের প্রথম সবাক বাংলা ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকেই ঢাকাই চলচ্চিত্র পায় শক্তিমান খলনায়ক। ছবিটির প্রধান চরিত্রই ছিল খলনায়কের। ডাকাতরূপী এই চরিত্রে অভিনয় করেন ইনাম আহমেদ। এই খলঅভিনয়শিল্পীর পর একে একে আসেন ফতেহ লোহানী, কাজী খালেক, মুস্তাফা, তুলিপ, জাভেদ রহিম, ফিরোজ ইফতেখার, মঞ্জুর রাহি, লিটন আখতার, মেহফুজ, খলিল, আহমেদ শরীফ, জুবের আলম, কায়েস, দারাশিকো, রাজু আহমেদ, রাজ, এ টি এম শামসুজ্জামান, বাবর, মতিন, মঞ্জুর  হোসেন, জসিম, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, মিজু আহমেদ, সিরাজ হায়দার, সাদেক বাচ্চু, জাম্বু, রাজীব, আদিল, নাসির খান, কাবিলা, হুমায়ুন ফরীদি, ডিপজল, ডন, ড্যানি সিডাক, মিশা সওদাগর, তাসকিন, শিমুলসহ অনেকে। বলতে গেলে দেশীয় চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই উল্লেখ করার মতো প্রচুর শক্তিমান খলনায়ক পাওয়া গেছে। খলনায়কদের মধ্যে এ টি এম শামসুজ্জামান ও মিশা সওদাগরের অভিন্ন মন্তব্য হলো- ‘ছবিতে নায়কের চেয়ে খলনায়কের গুরুত্ব বেশি। কারণ নায়ক  প্রেম করবে আর নেচে-গেয়ে বেড়াবেন। কিন্তু খলনায়ক ঘটনার মারপ্যাঁচ দিয়ে গল্পকে জটিল করে  তোলেন। ছবির গল্পের গতিসঞ্চারে খলনায়কের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঢাকার ছবিতে একসময় এই গুরুত্বপূর্ণ খলনায়ক চরিত্রে নায়করাও কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন। তাঁদের মধ্যে নায়ক ওমর সানী ও অমিত হাসানের নাম উল্লেখযোগ্য। শক্তিমান নায়ক আলমগীরও বেশকিছু ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় কাজ করেন। ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম ও  জাহিদ হাসানও বড় পর্দায় খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে শুধু দর্শকমনে শিহরণই জাগাননি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেছেন। ২০০০ সালের শুরু থেকে শিবা সানু, তনু পান্ডে, শিমুল খান, ডি জে  সোহেল, টাইগার রবিসহ অনেকে এখন এই চরিত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। আশির দশকে নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমে নায়ক হয়ে আসেন মিশা সওদাগর। পরে খলনায়কের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা পান ও নিয়মিত তুমুল জনপ্রিয়তায় অভিনয় করে যান তিনি। নবীন খলঅভিনেতা শাহেদ আলীর কথায়, ‘আমাদের নিয়ে নির্মাতারা তেমন আগ্রহ দেখান না। এ অবস্থা চলতে থাকলে নতুন শিল্পী তৈরি হবে কীভাবে। নতুন মুখ যারা আসবে তাদের ভালো কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের জন্য ভালো চরিত্রও তৈরি করতে হবে। যা অতীতে হয়েছিল।’ নবাব এলএলবি ছবিতে চমক দেখানো রাশেদ মামুন অপুরও একই মন্তব্য। চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, বর্তমানে খলঅভিনেতার সংকট কিন্তু তেমন নেই, সুযোগের অভাবে অনেকে কাজ দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। এর জন্য নির্মাতাদের মানসিকতাই দায়ী। দেশে নতুন পুরনো এত শিল্পী থাকতে বিদেশি শিল্পী নিয়ে কাজ করতে হবে কেন। আগে নিজের ঘরের দিকে তাকাতে হবে। বুঝতে হবে, একটি চলচ্চিত্রে খলঅভিনেতার গুরুত্ব সব থেকে বেশি। খলনায়ক ছাড়া চলচ্চিত্র প্রাণ পায় না। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ছবিতে ভিলেন অপরিহার্য চরিত্র। আগুন ছাড়া  যেমন পানি সেদ্ধ হয় না, ভিলেন ছাড়া তেমন নায়ক সেদ্ধ হয় না। ভিলেন যত শক্ত হবে, নায়ক তত পোক্ত হবে। সিনেমার কাহিনির মতোই ভিলেনের প্যাটার্ন কালচার অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। এই উপমহাদেশের ফিল্ম জগতে বহু দশক ধরেই ভিলেন ভীষণ দামি ও দর্শকপ্রিয়। যদিও সিনেমা হলে দর্শক ভিলেনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে, বাস্তবে দেখা হলে ঠিক তার উল্টো। ভিলেনের কাছে যেতে হুড়োহুড়ি লাগায়, ছুঁয়ে দেখে। কারণ, ভিলেন চরিত্রের অভিনেতারা খুব উঁচুমানের। তাঁরা
বাস্তবে জনপ্রিয় হন। স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্রে ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে শুরুতেই নজর  কেড়েছিলেন রাজু আহমেদ, জসিম, গোলাম মুস্তাফা, খলিলউল্লাহ খান। গোলাম মুস্তাফা ও খলিলউল্লাহ খান দুজনই সুদর্শন ছিলেন। প্রথমে নায়ক ছিলেন, পরে খলনায়ক হয়েছেন। ছবিতে খলনায়ক মানেই শুধু মারামারি বা কূটচাল করা নয়। এটি একটি জ্বলজ্বলে চরিত্র, উন্নত কুশলী অভিনয়। অনেক খলনায়ক আবার নিজেকে শুধু এ চরিত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা একসময় কৌতুক অভিনেতা বা বিশেষ কোনো চরিত্র রূপায়ণ করেও খলনায়কের মতো সমান দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছেন। যেমন কমেডি ও ভিলেন চরিত্রের সফল সমন্বয় ঘটান এ টি এম শামসুজ্জামান। মূলত ‘কুটনা ভিলেন’ চরিত্রটি তাঁর দখলে থাকলেও এর সঙ্গে কমেডি জড়িয়ে  ফেলেন তিনি। নায়ক থেকে খলনায়ক বনে যান ঢাকার কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। তাঁর খলচরিত্রেও কমেডি ছিল কিংবদন্তির মতো। শুধু ছবিতে নয়, টিভি নাটক ‘সংশপ্তক’-এ তাঁর ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্র এখনো দর্শকমনে গেঁথে আছে। ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায়, আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ অতীতকাল থেকে খলনায়কে তুমুল সমৃদ্ধ থাকলেও বিদেশ থেকে খলনায়ক  আমদানি করতে হবে কেন?

সর্বশেষ খবর