সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র কম কেন

আলাউদ্দীন মাজিদ

নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র কম কেন

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সংস্কৃতি জগতে নাটক ও চলচ্চিত্রে নারী অপরিহার্য অংশ। বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আশির দশক পর্যন্ত নারীপ্রধান নাটক ও চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো। চলচ্চিত্রের কথাই যদি ধরা হয় তাহলে দেখা যায়, একাত্তর-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব ছবি নির্মাণ হয়েছে তাতে নারীর অবদান এবং নির্যাতনের চিত্র সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতারা। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একটি নারীপ্রধান ছবি। এ ছবির স্লোগানই ছিল- ‘লাঞ্ছিত নারীত্বের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ সন্তানদের বরণ কর...’। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। এ ছবিতে রাত্রি চরিত্রটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন সহজ-সরল মেয়ে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে সাহসী হয়ে ওঠেন তা দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে সাহিত্যধর্মী ছবির ক্ষেত্রে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে তিনি একে একে নির্মাণ করেন নারীপ্রধান চরিত্রের ছবি নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধ প্রভৃতি। এ ছাড়া আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেন নারীপ্রধান চলচ্চিত্র সারেং বৌ; চাষী নজরুল ইসলামের শাস্তি ও সুভা; আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা; সুচন্দার তিন কন্যা ও হাজার বছর ধরে; মিতার আলোর মিছিল; হারুনূর রশিদের মেঘের অনেক রঙ; নার্গিস আক্তারের চার সতীনের ঘর, মেঘের কোলে রোদ, মেঘলা আকাশ, অবুঝ বউ, পুত্র এখন পয়সাওয়ালা, পৌষ মাসের পিরিত,  যৈবতী কন্যার মন, মৌসুমীর মেহের নিগার; জয়ার দেবী, চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’, তানিম রহমান অংশুর ‘ন ডরাই’ ইত্যাদি। অন্যদিকে ছোট পর্দায় সংশপ্তক, আজ রবিবার, অয়োময়, রাহুসহ প্রচুর নারীপ্রধান নাটক নির্মাণ হয় আশির দশক পর্যন্ত। দুঃখের কথা হচ্ছে, নারীপ্রধান চলচ্চিত্র ও নাটকের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু কেন? প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা সব সময়ই উপেক্ষিত। নারীদের আনন্দ-বঞ্চনা নিয়ে ছবি নির্মাণ নারীদের হাতেই যথাযথভাবে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ কম। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ বলেন, আগে কখনই নারীপ্রধান চরিত্র নিয়ে ছবি নির্মাণ তেমনভাবে হয়নি। কারণ সমাজে নারীদের বিচরণ ও কর্ম ছিল সীমিত। সমাজের নানা কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণও কম ছিল। আগে নারীদের ভাবা হতো শুধুই ‘গৃহবধূ’। তারা চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দী থাকবে এমনই ছিল মানসিকতা। এখন সময়ের বিবর্তনে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছেন একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। এখন এসপি পদেও নারীর অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া নানা সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। নারীদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে, তাই এখন সময় এসেছে নারীপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণের। খ্যাতিমান নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, নারী হিসেবে আমি যখন নির্মাণ করি তখন তাতে নারীদেরই প্রাধান্য দিই। অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কম বলেই বর্তমান সময় নারীপ্রধান নাটক নির্মাণ তেমনভাবে আর হয় না। আসলে ‘নারী ও পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক’ এ ভাবনাটি যতক্ষণ পর্যন্ত দেশ ও সমাজে প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী অবহেলিতই থেকে যাবে। প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা নার্গিস আক্তারের কথায়- নারীরা বেশির ভাগই পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে থাকে। তাই একজন পুরুষ নির্মাতা যখন নারীপ্রধান নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যান তখন তারা তাদের এ দুর্বল অবস্থানকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার সাহস পান না। ফলে নারীদের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-বঞ্চনার কথা অপূর্ণই থেকে যায়। তাই নারীদের কথা নারীদেরই তুলে ধরতে হবে। অভিনেত্রী মৌসুমীর কথায়, ‘নারীপ্রধান চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করতে গেলে একজন নারীর জীবনের পারিপার্শ্বিকতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের সমাজে নারীকে এখন পদে পদে নানা দুর্ভোগে পড়তে হয়। সংসার, কর্মক্ষেত্র বা রাস্তাঘাটে নারী খুব একটা নিরাপদ নয়। বর্তমানে এ বিষয়টি চলচ্চিত্র বা নাটকে তুলে ধরার মতো গল্প বা সাহসের অভাব রয়েছে বলেই নারীপ্রধান নাটক ও ছবি নির্মাণ কমে গেছে।  এক্ষেত্রে নারীরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

সর্বশেষ খবর