মঙ্গলবার, ৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক, মান নিয়ে সংশয়

চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক, মান নিয়ে সংশয়

সম্প্রতি কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান স্বল্প সময়ে নাম মাত্র বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছে এবং অনেকে করার ঘোষণা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ছবিপ্রতি ২০-২৫ লাখ টাকা বাজেট এবং এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যে ছবি নির্মাণের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তাতে ছবির মান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে চলচ্চিত্র জগৎসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ বিষয়ে বেশ কজন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বের মতামত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এটি অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা

জুনায়েদ হালিম [চলচ্চিত্র নির্মাতা,গবেষক ও শিক্ষক]

স্বল্প বাজেট আর সময়ে কীভাবে একটি মানসম্মত ছবি নির্মাণ সম্ভব? একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে যথেষ্ট গবেষণা, প্রস্তুতি, বাজেট আর সময়ের দরকার। সত্তরের দশকেও যখন ছবি নির্মাণ হতো তখনো একটি ছবির বাজেট ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা থাকত। এই অঙ্কের পরিমাণ তখন অনেক। ফলে ছবিটি মানসম্মত হতো এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে সিনেমা হলে চলত। কয়েক দশক পরে এসে এখন যদি কেউ ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় ছবি নির্মাণ করার কথা বলেন তখন এই স্বল্প অর্থে আসলেই কি সিনেমা নির্মাণ হবে না সিনেমার নামে আবর্জনা তৈরি হবে। এই সংশয় কিন্তু থেকেই যায়। এর আগে নানা নেতিবাচক কারণে চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বর্তমান সময়ে সে অবস্থার পুনরুদ্ধারে যখন প্রচেষ্টা চলছে তখন এমন একটি অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনা এই চেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেবে। জানিনা এর পেছনে আসলে কি উদ্দেশ্য রয়েছে। অতীতেও দেখেছি অনেকে কালো টাকা সাদা করতে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন। এটি প্রমাণিত নয়, প্রচলিত ধারণা। এখন কী এই প্রচলিত ধারণার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে এটি এই শিল্পের জন্য সত্যিই উদ্বেগের কারণ। সম্প্রতি সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। আমার ধারণা সরকারের এই সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল অশুভ তৎপরতা শুরু করেছে। এটি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা। এই অপতৎপরতা রোধে সরকারকে সজাগ হতে হবে। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো সরকারি একটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এই মন্ত্রণালয়কে চলচ্চিত্রবোদ্ধা, নির্মাতা, শিক্ষক, সাংবাদিকদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি চাই না অপেশাদার কেউ চলচ্চিত্রে এসে অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে দেশের এই প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্রকে আবার ধ্বংস করুক।

 

চলচ্চিত্রের জন্য অশুভ লক্ষণ

অনুপম হায়াৎ [সিনিয়র চলচ্চিত্র সাংবাদিক]

প্রথমে বলতে চাই করোনার কারণে চলচ্চিত্রশিল্পে যে ধস নেমেছিল তা উত্তরণে আবার প্রচুর পরিমাণে ছবির কাজ শুরু হওয়াকে শুভ লক্ষণ বলতে হয়। কিন্তু পরক্ষণে আশঙ্কায় পড়তে হয় যখন দেখি কেউ কেউ মান, মেধা, মননকে বাদ দিয়ে স্বল্প অর্থ ও সময়ে যেনতেনভাবে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। চলচ্চিত্র শুধু একটি ব্যবসায়িক পণ্য নয়, এটি শিল্পও বটে। এই চিন্তাচেতনা না থাকলে অর্থ ও মেধা দুইয়েরই অপচয় ঘটবে। দর্শক আর দেশি চলচ্চিত্র দেখতে সিনেমা হলে ফিরবে না। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে একদিকে সেই সরকারের দমন-পীড়ন অন্যদিকে উর্দু ছবির রাজত্বকে উপেক্ষা করে জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো ছবি নির্মাণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এটি শুধু একটি চলচ্চিত্র ছিল না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সোপানও ছিল। মনে রাখতে হবে একটি ছবি বিশ্বে একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এক্ষেত্রে মান ও গুণ না মানলে ছবিটি দর্শক প্রত্যাখ্যান করবে, চলচ্চিত্র জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

 

এমন নির্মাণ সার্বিক ক্ষতিকর 

কাজী ফিরোজ রশীদ [চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব]

চলচ্চিত্রের মান নির্ভর করে উপযুক্ত বাজেট, সময়, গল্প, নির্মাতা, গান, সংলাপ এবং গবেষণার ওপর। ২০-২৫ লাখ টাকায় তাড়াহুড়া করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে মানের অভাবে সেটি দর্শকগ্রহণযোগ্যতা হারাবে। এতে করে সার্বিকভাবে চলচ্চিত্র জগতের ক্ষতি হবে। আরেকটি কথা হলো, চলচ্চিত্র বা অন্য যা কিছুই হোক তা অবশ্যই সময় উপযোগী হতে হবে। যেমন বলিউডে সঞ্জয় লীলা বনশালী নির্মিত ‘দেবদাস’ ছবিটি সময় উপযোগী করে নির্মাণ করায় ব্যাপকভাবে সফল হয়। মনে রাখতে হবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিন্তা, প্রযুক্তিসহ সবকিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তাই কোনোভাবে স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে যা খুশি নির্মাণ করব আর তা দর্শক গ্রহণ করবে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। এ ধরনের নির্মাণ সিনেমা হল, শিল্পী, নির্মাতাসহ সমগ্র চলচ্চিত্র জগৎকে আবার ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে। দর্শক আর সিনেমা হলে ফিরবে না। মানহীন এত ছবির প্রয়োজন নেই। মাসে দুই-তিনটি মানসম্মত ছবি দিলেই সিনেমা হল মালিক ও নির্মাতা লাভবান হবেন।

 

মান তো থাকবেই না

কাজী হায়াৎ [চলচ্চিত্রকার]

স্বল্প বাজেট আর সময় নিয়ে নির্মাণ করলে মান কীভাবে থাকবে। চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে প্রযুক্তির কারণে। এখন ড্রোন, জিমিজিপ, স্টাডিক্যামসহ অনেক অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়। সার্বক্ষণিক একজন শিল্প নির্দেশকও রাখা হয়। এতে চলচ্চিত্রের লুকও উন্নত হয়। এখানে কার্পণ্য করে সবকিছু মাইনাস করে হাতুড়ি পদ্ধতিতে এখন মানসম্মত ছবি নির্মাণের সুযোগ নেই। এগুলো দর্শক কেন দেখবে? এই প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকেই যায়।

 

মানসম্মত ছবি চাই

আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল [কর্মকর্তা প্রদর্শক সমিতি]

সিনেমা হল চালু রাখার জন্য আমাদের এখন মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি দরকার। বাজেট কী তা সিনেমা হল মালিকদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের মান দরকার, যেন সিনেমা দেখতে দর্শক আবার সিনেমা হলে আসে। আমরা সিনেমা হলের মান বৃদ্ধিতে সারা দেশ ট্যুর করছি। নির্মাতাদের যদি মানসম্মত ছবি নির্মাণে সহযোগিতা দরকার হয় তাও করতে রাজি আছি। তারপরও নির্মাতাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা মানহীন ছবি দিয়ে এই শিল্পের ক্ষতি আর করবেন না।

সর্বশেষ খবর