মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘরবন্দী ববিতার এক বছর...

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঘরবন্দী ববিতার এক বছর...

অভিনেত্রী ববিতা

তখনো শেষ বিকালের সূর্য অস্ত যায়নি। বেলাশেষের হালকা আলোয় ছাদবাগানে ডুবন্ত সূর্য দেখতে দেখতে কিছুটা উদাস হয়ে ওঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা। চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ অনেক দূর থেকেও ঝাপসা আলোয় পরিষ্কার হয়ে ওঠছে। চোখের কোণে অজানা অশ্রু চিকচিক করছে। একসময় সম্বিত ফিরে পেলেন তিনি। বলে ওঠলেন, হয়তো আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু আগের পৃথিবী আর ফেরত পাব বলে তো মনে হচ্ছে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠলেন, করোনা চেনা পৃথিবীটাকে অনেক বদলে দিয়েছে। আমরা যতই বলি না কেন সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সেই আগের পৃথিবীটা ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। নতুনভাবে সবকিছু রিসেট করতে হবে। অর্থনীতি  থেকে শুরু করে প্রকৃতি। বেশি সমস্যা হবে পরবর্তী প্রজন্মের। হতাশার সুর কিছুটা নামিয়ে এবার ছাদবাগানের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললেন, প্রকৃতি হলো নিঃসঙ্গতার বড় সঙ্গী। আমার বাসার ছাদে প্রকৃতির রাজ্য। ছোটবেলা থেকে প্রকৃতি আমাকে খুব কাছে টানে। মনে হয় যেন ইশারায় শিস দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বার বার আমি প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই। করোনা মহামারী গত এক বছর ধরে অনেকের মতো আমাকেও ঘরবন্দী করে রেখেছে। আশপাশে কেউ নেই। বড় একা আমি। আর আমার এই একাকিত্ব অনেকটাই দূর করে দিচ্ছে প্রকৃতি। মানে ফুল, পাখি আর গান।

আলো ঝলমলে রাজপ্রাসাদ নয়, বিশাল এক প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার। গুলশানে ববিতার বাসায় প্রবেশ করলেই ফুলের সৌরভ-সৌন্দর্য আর পাখির কলতানে অনাবিল মুগ্ধতায় ভাসতে হয় যে কাউকে। এই স্বর্গীয় প্রকৃতি গড়ে তুলেছেন গ্লামার কুইন নায়িকাখ্যাত ববিতা নিজেই। ফুল আর পাখির অনাবিল আনন্দে বিমোহিত এই মহানায়িকা জানালেন গত এক বছর ধরে ঘরবন্দী জীবনে বিষণ্ণতা আর আতঙ্কে সময় কাটছে তাঁর। গত বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এক দিনের জন্যও ঘরের বাইরে বের হননি তিনি। বললেন, এমনকি লিফটও ব্যবহার করি না। প্রকৃতি আর সাবধানতার সঙ্গেই এখন বসবাস আমার। বাড়ির ভিতরে কাজকর্ম ও ব্যায়াম করে মন ভালো রাখার চেষ্টা আমার প্রতিটা মুহূর্তে। ছাদবাগান পরিচর্যা করছি। ছাদে মাটির চুলায় রান্না করছি। নিয়মিত নামাজ পড়ছি। চেষ্টা করছি সবসময় কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। যেন বিষণ্ণতা থেকে দূরে থাকা যায়। প্রায় এক বছর পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনার ভ্যাকসিন নিতেই শুধু অল্প সময়ের জন্য ঘরের বাইরে বের হয়েছিলাম। মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন দিয়ে আবার বাসায় চলে এসেছি। বলতে পারেন এক বছর করোনা আমাকে গৃহবন্দী করেই রেখেছে।

হতাশার সুরে ববিতা বলেন, প্রতি মুহূর্তে অজানা একটা শঙ্কা কাজ করছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছে। আমার ছেলে অনিক কানাডায় থাকে। বড় বোন সুচন্দার শরীরটাও ভালো নেই। জানুয়ারিতে হার্টের বাইপাস সার্জারি হয়েছে তাঁর। এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন। ছোট বোন চম্পা বাসায়ই থাকে। মেজো ভাই আমেরিকায় থাকেন। আরেক ভাই অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁরা দূরে থাকায় চিন্তাটা  বেশি হচ্ছে। যদিও নিয়মিত ভিডিওকলে কথা হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যেও চেষ্টা করছি শান্ত থাকতে। এ ছাড়া পুরনো সিনেমা দেখে সময় কাটছে। সত্যজিৎ রায়, জহির রায়হান, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেনসহ ভালো ভালো চলচ্চিত্রকারের ক্ল্যাসিক সিনেমাও  দেখছি। অবসর পেলে হাঁটাহাঁটি করি। এসব রুটিনই হয়ে গেছে। গান শুনে মনকে যতটা পারি ডাইভার্ট করার চেষ্টা করি। করোনার এই দুঃসহকাল শেষ হবে কবে? এমন দুশ্চিন্তা মনকে ভারাক্রান্ত করেই রাখে সারাক্ষণ। একটা বড় দুঃখের সংবাদ হচ্ছে- আমার পরিবারের অনেক কাছের মানুষকে করোনা  কেড়ে নিয়েছে। চোখের সামনে তাঁদের মুখ যখন  ভেসে ওঠে, তখন বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। আমার মন খারাপের আরও একটা কারণ হচ্ছে বছরে দুবার ছেলের কাছে যেতাম। এখন তাও পারছি না। সেসব কষ্টের এপাশ ওপাশ নিয়ে বেঁচে আছি।

দুঃখভারাক্রান্ত ববিতা বলেন, সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হয়। কিন্তু আমরা একাই ভালো থাকতে  চেয়েছি। অন্যকে ভালো না রেখে নিজে ভালো থাকা যায় না। করোনার আঘাত বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। তা ছাড়া মানুষ যেভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, সেটি ছিল অন্যায়। প্রকৃতি দ্বারা যে আমরা নিয়ন্ত্রিত এ বিষয়টি মানুষ আগামীতে ভুলে যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ সবকিছু রাতারাতি আগের মতো হয়ে যাবে না। বরং আগের জীবনটা মনে হবে স্বপ্নের মতো। এসব কিছুর সামনে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড়িয়ে আছে। যার কোনো উত্তর নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর