শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বন্ধু ওয়াসিমের সঙ্গে শেষ দেখা হলো না

বন্ধু ওয়াসিমের সঙ্গে শেষ দেখা হলো না

‘পরম বন্ধু ও সহযোগিতাপরায়ণ সহকর্মীকে হারিয়ে আজ আমি ব্যথিত।’ অভিনেতা ওয়াসিমকে হারিয়ে এভাবেই হাহাকার করে উঠলেন অভিনেত্রী রোজিনা। দেশীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সার্থক জুটি বলা হয় ওয়াসিম-রোজিনাকে। ৭৫টিরও বেশি ছবিতে তারা জুটি বেঁধেছেন। বাস্তবেও তারা ছিলেন পরম বন্ধু। প্রিয় মানুষটিকে ঘিরে ও অন্যান্য প্রসঙ্গে অভিনেত্রী রোজিনার সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ওয়াসিম নেই এ কথা বিশ্বাস করতে চাই না-

কিছু কিছু মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতে মন চায় না। আমি এখনো ভাবি পরম বন্ধু ওয়াসিমের মৃত্যুর খবরও মিথ্যা। সবাইকে চলে যেতে হবে জানি, কিন্তু তাঁর মতো একজন সজ্জন ও সহযোগিতাপরায়ণ অভিনেতার চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আজ বারবার মনে পড়ছে আমাদের অভিনয় জীবনের সোনালি দিনের কথা। যা কোনো দিন ভুলতে পারব না।

 

তাঁর সঙ্গে অভিনয় করা পরম আনন্দের-

একক নায়িকা হিসেবে আমার প্রথম ছবি ‘রাজমহল’। ছবিতে ওয়াসিম ছিলেন আমার নায়ক। তখন তিনি সুপারস্টার আর আমার  মাত্র শুরু। তাঁর মতো একজন বড় মাপের অভিনেতার বিপরীতে কাজের প্রস্তাব ছিল স্বপ্নের মতো। ভয়ও কাজ করছিল। পর্দায় ওয়াসিমের সামনে ঠিকভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারব কি না, এ নিয়ে ভয় ছিল। কিন্তু প্রথম দিনের শুটিংয়েই সব ভয় দূর করে দিয়েছিলেন ওয়াসিম ভাই। গল্প-চরিত্র নিয়ে এমনভাবে আলোচনায় বসেছিলেন যেন বহুদিনের চেনা-জানা আমাদের। শুটিং শুরু হলো এফডিসির চার নম্বর ফ্লোরে। পরিচালক এফ কবির সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন ওয়াসিমের সঙ্গে। প্রথম পরিচয়েই আপনি বলে ডাকতে শুরু করলেন। অনেক বিনয়ী, ভদ্র ছিলেন। পরে আমি তাঁকে বললাম আপনি না করে তুমি বা তুই করে বললে খুশি হব। পরে বললেন ধন্যবাদ। ১৯৭৭ সালে ‘রাজমহল’র শুটিং করি। মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ‘রাজমহল’ আমার জীবনের গল্প বদলে দিয়েছিল। ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে ৭৫টির মতো ছবিতে কাজ করেছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করা ‘জীবন ধারা’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর সম্মানও পেয়েছি।

 

তাঁর তুলনা তিনি নিজেই-

আমি ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে কারও তুলনা করতে চাই না। সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল ভাই স্ট্যাবলিশড, সুপারস্টার। সবার সঙ্গে আমাদের ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক। তবে ওয়াসিম ভাই অন্যরকম আন্তরিক ছিলেন।

 

তাঁকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জমা আছে-

ওয়াসিম ভাইকে ঘিরে অনেক স্মৃতি মনের গহিনে জমা আছে। তাঁর সঙ্গে যখন কাজ করতাম, মনে হতো একেবারে বাস্তবে আছি আমরা। যেমন ‘বিনি সুতার মালা’ ছবির শুটিং হয় কুয়াকাটা ও সাভারে। ছবির গল্পে ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রেম। কিন্তু গ্র্রামের মোড়ল আমাকে হরণ করে। পায়ে শিকল বেঁধে পালকিতে আমাকে বিয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সেই পালকিওয়ালা হলেন ওয়াসিম। তিনি যখন আমাকে দেখেন, দুজনেই কেঁদেকেটে অস্থির। সেই কান্না শুটিং শেষ হলেও আমরা থামাতে পারিনি। এরপর ফখরুল হাসান বৈরাগী ভাইসহ অনেকে এসে আমাদের কান্না থামানোর চেষ্টা করেন। এ ছবিতেই আরও একটি দৃশ্য আছে। অন্ধকারে আমি ও ওয়াসিম ভাই দৌড়ে পালাতে থাকি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি পা পিছলে নদীতে পড়ে যাই। বিষয়টি ওয়াসিম ভাই টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পানিতে লাফ দেন। আমি সাঁতার জানতাম না। এদিকে আমাদের দেখে মোড়লের লোকজনও পানিতে ঝাঁপ দেয়। তারা ভাবে, তখনো শুটিং চলছে। পরে ওয়াসিম ভাই বলে, ‘তোমরা থামো, এটা দৃশ্য না। রোজিনা পড়ে গেছে!’

 

শেষ দেখা আমাদের-

ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল দুই বছর আগে। বিটিভিতে বুশরা চৌধুরীর অনুষ্ঠানে। এ ছাড়াও গত শিল্পী সমিতির নির্বাচনে দেখা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাব। সেটা আর হয়নি। তবে কথা যে হতো না, তা নয়। মাঝে-মধ্যেই ফোনে কথা হতো।

 

তাঁর ফটো দেখে খারাপ লেগেছিল-

কিছু দিন আগে আমার পরিচালিত ছবি ‘ফিরে দেখা’র কাজে গোয়ালন্দ ছিলাম। তখন ওয়াসিম ভাইয়ের একটি ফটো আমাকে একজন পাঠিয়েছিল। দেখলাম, চেহারাটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। জানলাম খুব অসুস্থ তিনি। ভেবেছিলাম ঢাকায় ফিরে তাঁকে দেখতে যাব। আমি গোয়ালন্দ থেকে ফিরলাম। কিন্তু আর যাওয়া হলো না।

 

ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে রসায়ন চমৎকার ছিল-

ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার রসায়নটা দর্শক গ্রহণ করেছিল, তাই নির্মাতারাও আমাদের চাইতেন। সে জন্যই আমাদের সবচেয়ে বেশি ছবি করা হয়েছে। নিজেদের ভিতর বোঝাপড়াটা ভালো ছিল, একাত্মতা ছিল। ছবিও ভালো ছিল। সব মিলিয়ে প্রযোজকরা ভাবতেন আমাদের নিলেই ছবি ব্যবসাসফল হবে। সে জন্যই বেশি ছবি করা।

 

বড্ড হাসিখুশি একজন মানুষ ছিলেন

‘ওয়াসিম সেটের মধ্যে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে পারতেন না। বড্ড হাসিখুশি ও পরিপাটি স্বভাবের একজন অসাধারণ মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ছবির সেটে জোকস বলে সবাইকে হাসাতেন। বডি বিল্ডার ছিলেন। ছিলেন স্বাস্থ্যসচেতন। নেশা জাতীয় কিছু পান করতেন না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কাউকে কখনো মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলেননি। পরিপূর্ণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য স্ত্রী-কন্যার অকাল মৃত্যুর পর ২০০৬ সালে অভিনয় থেকে দূরে সরে যান তিনি।

 

কবরীর সঙ্গে শেষ দেখা

আমরা দুজন সরকারি অনুদান চলচ্চিত্রের জুড়ি বোর্ডের সদস্য। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা ৩১ মার্চ। ওই দিন আমরা একসঙ্গে দুটি ছবি দেখেছিলাম। দুজন মিলে কম গল্প করলাম সেদিন। তাঁর হঠাৎ এমন বিদায় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তিনি যে সমৃদ্ধ কর্মভান্ডার রেখে গিয়েছেন, তা আজীবন বেঁচে থাকবে।

 

বর্তমান ব্যস্ততা আমার-

প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করছি। ছবির নাম ‘ফিরে দেখা’। শুটিং প্রায় শেষের দিকে। হাসপাতালের একটা দৃশ্যায়ন বাকি আছে। এর মধ্যে ডাবিংটা শেষ করব। অনুদানের সিনেমা ধাপে ধাপে জমা দিতে হয়। ৩০ পারসেন্ট জমা দিয়েছি। ছবিটিতে একাত্তরের ফ্লেভারটা আনার চেষ্টা করেছি।

 

অভিনয়ের ইচ্ছা আছে-

চলচ্চিত্রের অবস্থা অনুকূল থাকলে নিয়মিত পরিচালনার ইচ্ছা আছে। পরিকল্পনা আছে, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গল্প নিয়ে কাজ করার। এখন আসলে অভিনয়ের চেয়ে নির্মাতা হিসেবে কাজ করার বেশি ইচ্ছা। অভিনয় যে করার ইচ্ছা একদম নেই, তাও নয়। চরিত্র অনুযায়ী ভালো কিছু পেলে হয়তো করতেও পারি, তবে আগের মতো অতটা আগ্র্রহ নেই অভিনয়ে। গল্পভিত্তিক যদি ভালো চরিত্র পাই তাহলে অভিনয় করতে পারি।

 

নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আমি-

জীবন নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। নেই কোনো আক্ষেপ। আমাকে নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। মাঝেমধ্যে কোনো কিছু মনের মধ্যে উঁকি দিলে বোরকা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকি।

পিঠা বিক্রেতা, চা-দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জীবনটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। মনে হয়, আমি তো অনেক ভালো আছি। বলতে পারেন আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই। আমি খুব সুখী  এবং পরিপূর্ণ একজন মানুষ।

সর্বশেষ খবর