বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

টিভি নাটকের উদ্ভট নাম

টিভি নাটকের উদ্ভট নাম

নাম নাটকের অলঙ্কার, সৌন্দর্য। আগে নাটকের নামগুলোতে পাওয়া যেত কাব্যিক ছোঁয়া। এখন সেই অবস্থা নেই! ভিউ বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের উদ্ভট সব নাম রাখা হচ্ছে। বাংলা নাটকে একনাগারে রাখা হচ্ছে ইংরেজি নাম।  এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

নাটকের মান নেমে গেছে অনেক আগেই। আর বোকাবাক্স হয়ে গেছে জোকারবাক্স! টিভি চ্যানেলের দীনতা ও মানহীন নাটক প্রচারের কারণে হয়ে পড়েছে দর্শকবিহীন। প্রথমদিকে ইউটিউব প্ল্যাটফরম আশার আলো দেখালেও ওপেন প্ল্যাটফরম হওয়ার কারণে যাচ্ছেতাই ও মানহীন নাটক প্রচার হচ্ছে। ভিউ ধরার ফাঁদে দর্শককে আকৃষ্ট করতে অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্ল্যাটফরম উদ্ভট গল্পের ও নামের নাটক নির্মাণ করছেন। অন্যদিকে টিভি নাটক চ্যানেলের হাত থেকে চলে গেছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হাতে। তারা নাটকের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে! ইউটিউবের পর ওটিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে সবার আশাব্যঞ্জক সাড়া ছিল। তবে তার দিক থেকেও বিভিন্ন কারণে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভালো কনটেন্ট না দিতে পারাটা একটা অন্যতম কারণ। যদিও কিছু কিছু পরিচিত ইউটিউব ও ওটিটি প্ল্যাটফরম তাদের ইমেজ ধরে রাখতে সাহিত্যনির্ভর কাজ করে যাচ্ছে। এটি স্বস্তিদায়ক বটে।

এ দেশের টিভি নাটকের রয়েছে সুন্দর সোনালি অতীত। তখনকার নাটক মানেই তুমুল জনপ্রিয়তা। নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। কি সুন্দর সব নামের, গল্পের, সংলাপের ও অভিনয়ের নাটক! সোনালি সময় থেকে নব্বই-পরবর্তী সময়ও অসংখ্য সুন্দর নামের নাটক নির্মিত হয়েছে। ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকী জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘পারলে না রুমকী’, ‘আজ রবিবার’, ‘রূপনগর’, ‘নিমফুল’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘তথাপি’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘বিপ্রতীপ’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘নাইওরী’, ‘তুমি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘ইতিকথা’, ‘বন্ধন’সহ সুন্দর নামের অসংখ্য নাটক। প্যাকেজ নাটক প্রচার শুরু হওয়ার পর এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসার পরও কিছু কিছু ধারাবাহিক নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সাহিত্যনির্ভর গল্প নিয়ে তৈরি হতো টেলিভিশন নাটক। নামগুলোতেও পাওয়া যেত কাব্যিক ছোঁয়া। নাটক দেখে মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের জীবনাচরণ ঠিক করে নিত সে সময়। কিন্তু এখন নাটকের ভিউ বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য নাটকের যাচ্ছেতাই নাম রাখা হচ্ছে। নাটকের মান তো অনেক আগেই গেছে। দর্শক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিম্নমানের গল্প, উদ্ভট ও অশ্লীল সংলাপ, নতুনদের বিরক্তিকর অপেশাদারী অভিনয়, নির্মাতাদের আনাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি ইদানীং যোগ হয়েছে নাটকের উদ্ভট সব নাম! আবার ভিউ ধরতে ব্যবহৃত হচ্ছে অসামঞ্জস্য ইংরেজি নাম। এই সময় দর্শক আকৃষ্ট করতে পোস্টার তৈরিতে বেশি ক্রিয়েটিভিটি দেখানো হচ্ছে। সেই অর্থে নাটকের মানের দিকে কোনো খেয়াল নেই প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের। গত কয়েক বছরে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল ও ইউটিউবে প্রচার হওয়া কয়েকটি নাটকের উদ্ভট ও অশ্লীল নাম যদি উল্লেখ করি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- আন্ডার সেইভ, পা, ফাইস্যা গেছি, এক্সবয় ফ্রেন্ড, মি. অ্যান্ড মিসেস চাপাবাজ, দৌড়ের ওপর ঔষধ নাই, লাড্ডু সোনা, সেন্ড মি নুডস, বেড সিন, ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা, ফালতু, প্লে-বয়, ক্রেজি লাভার, ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড, আফ্রিকান বউ, চ্যাতা কাশেম, ছ্যাঁছড়া জামাই, প্রোটেকশন, শোবার ঘর, ইংলিশ জামাই, আনম্যারিড কাপল, টম জেরি, ফিমেল, ডে কেয়ার, সেইরকম বাকিখোর, সেলিব্রেটি কাউ, মিউচুয়াল ব্রেকআপ, ম্যানেজ মকবুল, হেভিওয়েট মিজান, এক্সফেল মফিজ, কেন একসেপ্ট করবা না, মি. গিট্টু, বেবি গার্ল, তেজপাতা, রক রবীন্দ্র, কম খরচে ভালোবাসা, ডেঞ্জার বৌ, বড্ড নাটুকে, বেহায়া জামাই, ব্যাচেলর পয়েন্ট, হ্যালো লেডিস, এক্সচেঞ্জ, নটি ভার্সেস কিউটি, টু ইন ওয়ান, গার্ল ফ্রেন্ড যখন ভাবী, বিলাই রাশি, মাস্ক, বদমাইশ পোলাপাইন, ব্যাচেলর বাবু, হান্ডেড পারসেন্ট ফেইক, চাপাবাজ, তিন চোর, গরুর মাংস, ড্যান্সিং কার ইত্যাদি। যদিও পরিচালক বা প্রযোজকের মতে, এমন আকর্ষণীয় নাম না হলে মানুষ নাটক দেখতে আগ্রহী হয় না; দর্শকরা এমন উদ্ভট নামই পছন্দ করে। তবে এমন নিম্নমানের নিম্ন রুচিসম্পন্ন নাটকের নাম নিয়ে নাটক-সংশ্লিষ্ট অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। দিন দিন নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে মধ্যবিত্ত দর্শক। নাটকের নাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা অনেক পরিচালক ও টিভি কর্মকর্তারা বুঝতে চান না। কিছুদিন আগেও ঝালখোর, সিকন্দারবক্স, আরমান ভাই, কিড সোলায়মান ইত্যাদি নামনির্ভর নাটক নির্মিত হতো। তা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে এ সময়ও ভালো নামের ও গল্পের নাটক ও কনটেন্ট নির্মিত হচ্ছে। তা খুবই অপ্রতুল। যেমন- এই শহরে, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, মায়া সবার মতো না, কাঠপেন্সিলের কাহিনি, বড় ছেলে, ভিকটিম, বিকেল বেলার পাখি, শিফট, যদি আমি না থাকি, বোধ, ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদের ছিল, ইতি মার মতো সুন্দর নামের নাটকও আছে। 

ইদানীং নির্মিত নাটকগুলোর নামের সিংহভাগই ইংরেজি। যদিও বাংলা নামের পাশাপাশি ইংরেজি নাম ব্যবহারের রীতি আগেও ছিল। তবে ইদানীং ইংরেজি নামের প্রতি টান যেন বেশিই। বাংলা নাটকে অযথা ইংরেজি নামকরণ সবার কাছে হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এই ট্রেন্ডটা দেখা যাচ্ছে। এখন বাংলা নামের নাটক খুব কম চোখে পড়ে। নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাটক-সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন। নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এগুলো আসলে বাজে রুচির পরিচায়ক। কি বিশ্রী ও অশ্লীল নাম! নাম শুনে বোঝা যায়, এসব পরিচালক কি ধরনের নাটক বানিয়েছেন। এসবের জন্য দায়ী চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন প্ল্যাটফরমের প্রযোজক। তাঁরা ভিউ ধরার জন্য এমন অদ্ভুত নাম ব্যবহার করছেন। আমি খুবই বিরক্ত। সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এমন নামের নাটককে অভিনয়শিল্পীদের রিফিউজ করার মানসিকতা থাকা দরকার। তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।’ অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সম্প্রতি প্রচারসর্বস্ব নাটকের পোস্টার ট্রেন্ড নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছিলেনও। তাঁর মতে, যতটা গুরুত্ব দিয়ে একজন ডিজাইনারকে দিয়ে নাটকের পোস্টার তৈরি করা হয়, সে তুলনায় মূল কাজ অর্থাৎ নাটক তৈরিতে অধিকাংশ নির্মাতা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে সবার বলা উচিত। কিন্তু সবাই তো চুপ করে থাকেন। চুপ করে থাকতে থাকতে নাটকের মানের এই বেহাল অবস্থা। আসলে নাটকের নাম পরিশীলিত, শৈল্পিক ও অর্থপূর্ণ হওয়া উচিত।’ নাট্যজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘একটা ঢেউ আসে, করোনার মতো। তবে এটিও কিছুদিন পর বিলীন হয়ে যাবে। শুধু নাম কেন, মেকিং, সংলাপ প্রক্ষেপণ, এডিটিংও জঘন্য হয়ে গেছে। কমেডির নামে চলছে ভাঁড়ামি। এত ভিউ দিয়ে কি হবে, যদি নাটক ইন্ডাস্ট্রির এই বেহাল অবস্থা হয়? তবে নতুন ভালো মেকার ও শিল্পীরা আশার আলো দেখাচ্ছেন। ভালো কিছু হবে সামনে।’ জানা যায়, টিভি চ্যানেল বা ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকের সেন্সর না থাকায় নির্মাতারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা ছাড়াই উদ্ভট নামের নাটক বানিয়ে চলেছেন। এসব নামের দুই-একটি নাটক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এখন সবাই এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। এসব নাটকের নির্মাতাদের তালিকায় সিনিয়র থেকে তরুণ, সব কাতারের নির্মাতাই আছেন। গল্পের কমন ফর্মুলা এখন দুজন তরুণ-তরুণীর লুতুপুতু প্রেম অথবা গ্রুপ বন্ধু-বান্ধবীদের অযথা বাক্যবাণ। সেখানে না থাকছে গল্প, চরিত্র, অভিনয়শিল্পীদের বৈচিত্র্যতা, প্রমিত সংলাপ আর লোকেশনের বৈচিত্র্য। ঘুরে-ফিরে সেই একই মুখ। নাটকের অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয় গান। এসব নিয়ে নাটক-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এখনই ভাবার সময় বলে সবাই মনে করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর