বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগ : গানেই হিট হতো ছবি

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগ : গানেই হিট হতো ছবি

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে, রাতেরও আঁধারে দোসরও হয়ে তাই সে আমারে টানে’... ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির গান এটি। ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় প্রখ্যাত নির্মাতা এহতেশাম পরিচালিত এ ছবিটি। কে জি মোস্তফার লেখা এবং রবীন ঘোষের সুর ও সংগীত পরিচালনায় উপমহাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের গাওয়া এ গানটি আজও শ্রোতাদের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে। বলা হয়ে থাকে, ওই ছবির এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, শুধু গানটি দেখার জন্যই বারবার দর্শক ছুটে গেছেন সিনেমা হলে। ফলে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিটি সুপারহিট হয়।

গানের ক্যারিশমা ছবির সাফল্যের অন্যতম নিয়ামক বলে খোদ এহতেশামই বলেছিলেন। একসময় চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হতো- ‘আসিতেছে গানের ছবি, প্রাণের ছবি...’, মানে নির্মাতারা ছবি হিট করার জন্য গল্পের পাশাপাশি গানকে প্রাধান্য দিতেন আর সুফলও পেতেন। মানে গানের জোরেই ছবি হিট হয়ে যেত। এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। এই অবস্থাটা বিশেষ করে ছিল চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগে, মানে আশির দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াতের কথায় গান হচ্ছে ছবির অন্যতম অনুষঙ্গ। যেহেতু চলচ্চিত্র হচ্ছে বিনোদন মাধ্যম, তাই দর্শকদের বিনোদিত করতে মার্জিত ও মনকাড়া কথায় চমৎকার সুরে গান তৈরি করতে হবে। তাহলেই দর্শক ছবিতে মনের মতো গান পেয়ে বারবার ছবিটি দেখবে এবং ছবিটি সফলতা পাবে।

আগে নামকরা সব গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক আর কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। যেমন- কে জি মোস্তফা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ জামান চৌধুরী, আমজাদ হোসেন, খান আতাউর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী প্রমুখ গীতিকার। আর সংগীত পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন- সুবল দাস, সত্য সাহা, আলম খান, শেখ সাদী খান, আনোয়ার পারভেজ, আবু তাহের, মনসুর আলী, আলী হোসেন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আজাদ রহমান, আলাউদ্দীন আলী প্রমুখ। কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম হলেন- খন্দকার ফারুক আহমেদ, আবদুল আলীম, মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আবদুল হাদী, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, ফেরদৌস ওয়াহিদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, বারী সিদ্দিকী, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাম্মী আখতার প্রমুখ। এ ছাড়া তখন আরও অনেক সুরকার, সংগীত পরিচালক, কণ্ঠশিল্পীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা আর গবেষণার ফসল হতো একটি হিট গান। একটি গান তৈরিতে আগে কয়েক মাস সময় লেগে যেত। এখন সে অবস্থা নেই। এক বসায় গান লেখা, সুর দেওয়া আর সংগীত পরিচালনা হয়ে যায়। স্বল্প সময়ে এই গান তৈরির ফলে তাতে গভীরতা বলে কিছু থাকে না আর দর্শকদের মনে স্থায়ী আসনও গড়ে নিতে পারে না। এ কারণে গানও হিট হয় না, ছবিও দর্শক দেখে না। সাদাকালোর যুগে গান দিয়ে যেসব ছবি হিট হয়েছে এমন তালিকার মধ্যে রয়েছে- ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’ (সুতরাং, ১৯৬৪), ‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো’ (রূপবান, ১৯৬৫), ‘ও সাতভাই চম্পা জাগোরে’ (সাতভাই চম্পা, ১৯৬৮), ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ (ময়নামতি, ১৯৬৯)। ‘নীল আকাশের নীচে আমি’ (নীল আকাশের নীচে, ১৯৭০), ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ (এতটুকু আশা, ১৯৬৮), ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’ (পিচঢালা পথ, ১৯৭০), ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ (জীবন থেকে নেয়া, ১৯৭০), ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ (স্বরলিপি, ১৯৭০), ‘যারে যাবি যদি যা, পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’ (আপন পর, ১৯৭০), ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ (নাচের পুতুল, ১৯৭১), ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এই গান’ (অশ্রু দিয়ে লেখা, ১৯৭২), ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ (অবুঝ মন, ১৯৭২), ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’ (অতিথি, ১৯৭৩), ‘সে যে কেন এলো না কিছু ভালো লাগে না’, ‘হই হই হই রঙিলা’ (রংবাজ, ১৯৭৩), ‘এই পৃথিবীর তরে কত ফুল ফুটে আর ঝরে’ (আলোর মিছিল, ১৯৭৪), ‘মনেরে রঙে রাঙাবো’ (মাসুদ রানা, ১৯৭৪), ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই, বল বেঈমান’ (বেঈমান, ১৯৭৪), ‘মালকা বানুর দেশেরে বিয়ের বাদ্য আল্লা বাজেরে’ (মালকা বানু, ১৯৭৪) ‘ও অনুপমা ও নিরূপমা’ (জিঘাংসা, ১৯৭৪), ‘ওগো তুমি যে আমার কত প্রিয়’ (লাভ ইন সিমলা, ১৯৭৫), ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কেন সৈকতে পড়ে আছি’ (আলো তুমি আলেয়া, ১৯৭৫), ‘ভালোবাসার মূল্য কত’ (এপার ওপার, ১৯৭৫), ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’, ‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়’ (সুজন সখী, ১৯৭৫), ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ (দোস্ত দুশমন, ১৯৭৫), ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ (সূর্যকন্যা, ১৯৭৬), ‘ও আমার রসিয়া বন্ধুরে’, ‘মাগো মা ওগো মা’ (সমাধি, ১৯৭৬), ‘ইশারায় শিষ দিয়ে আমাকে ডেক না’ (বন্দিনী, ১৯৭৬), ‘চুল ধইর না খোঁপা খুলে যাবে যে নাগর’, ‘নানী গো নানী’ (নয়নমণি, ১৯৭৬), ‘মা তোর কান্না আমি সইতে পারি না’ (আগুন, ১৯৭৬), ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই’ (অনন্ত প্রেম, ১৯৭৭), ‘তোমার এই উপহার আমি চিরদিন’ (পিঞ্জর, ১৯৭৭), ‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে’ (সোহাগ, ১৯৭৮), ‘একটুসখানি দেখ একখান কথা রাখ’ (বধূ বিদায়, ১৯৭৮), ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’, ‘ঢাকা শহর আইস্যা আমার’ (অশিক্ষিত, ১৯৭৮), ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি’ (অনুরাগ, ১৯৭৯), ‘দিন যায় কথা থাকে’ (দিন যায় কথা থাকে, ১৯৭৯), ‘হায়রে কি সৃষ্টি’ (ঘর সংসার, ১৯৭৯), ‘তুমি আরেকবার আসিয়া’ (নদের চাঁদ, ১৯৭৯), ‘আমার নায়ে পার হইতে’ (মাটির ঘর, ১৯৭৯), ‘চিঠি আসবে জানি আসবে’ (আরাধনা, ১৯৭৯)। ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’, ‘একদিন ছুটি হবে’ (ছুটির ঘণ্টা, ১৯৮০), ‘তোমাকে পেয়ে আমি সোহাগিনী’ (বৌরানী, ১৯৮০), ‘এই নীল মণিহার’ (ঘুড্ডি, ১৯৮০), ‘তোমারই পরশে’ (অংশীদার, ১৯৮১), ‘ওই রাত ডাকে আর চাঁদ জাগে আজ তুমি কোথায়’ (কাজল লতা, ১৯৮২), ‘এমনো তো প্রেম হয়, এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’ (দুই পয়সার আলতা, ১৯৮২), ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ (বড় ভালো লোক ছিল, ১৯৮২), ‘হারজিত চিরদিন থাকবে’ (পুরস্কার, ১৯৮৩), ‘আমি চাঁদের সঙ্গে দেব না  তোমার তুলনা’ (আশীর্বাদ, ১৯৮৩) প্রভৃতি।

সর্বশেষ খবর