শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে টিকটক

অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে টিকটক

বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীদের কাছে সবচেয়ে আলোচিত অ্যাপের নাম টিকটক। অ্যাপটি দিয়ে ভিডিও তৈরি ও শেয়ারের মধ্য দিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়ার নেশায় মেতেছে একদল তরুণ-তরুণী। আর তাদের সঙ্গে পিছিয়ে নেই তারকারাও। এই নতুন প্রজন্মের প্রায় সব অভিনেত্রীর টিকটক অ্যাকাউন্ট আছে বলে জানা যায়। নানা গানের, সংলাপের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন তাঁরা। আমাদের এই সংস্কৃতিতে টিকটক কতখানি প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন সংস্কৃতি ও শিক্ষকমহলের কয়েকজন গুণী। তাঁদের কথাগুলো তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ আলী আফতাব

 

প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাড়ছে সামাজিক দূষণ

হানিফ সংকেত [মিডিয়া ব্যক্তিত্ব]

চীন থেকে আসা অ্যাপ ‘টিকটক’ যেন চীন থেকে আসা করোনার মতোই আমাদের এখানে ‘সমাজদূষণ ভাইরাস’ ছড়াচ্ছে। এই অ্যাপটি প্রতিভাবান ও প্রতিভাহীন যে কাউকে কনটেন্টভেদে খুব সহজেই পরিচিত করতে পারে। পেশাদার ক্যামেরা, শব্দযন্ত্র, কারিগরি দক্ষতা, নির্মাণ ব্যয়, সময়ক্ষেপণ, অভিনয়শৈলী কোনো কিছু ছাড়াই ইন্টারনেটে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের সহজ পথ দেখিয়েছে এই চায়নিজ অ্যাপটি। প্রয়োজন শুধু একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। টিকটকের একটি তথ্যমতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছে। ডাউনলোড চার্টের শীর্ষেও রয়েছে এই টিকটক। সহজ বিনোদনের এই মাধ্যমটিতে অনেকেই নিজ ভাষার বদলে হিন্দি ভাষায় ঠোঁট মেলাচ্ছে, অভিনয় করছে। এখানে অধিকাংশ ভিডিওতেই দেখা যায় অশোভন পোশাকে অশালীন ভঙ্গিতে নৃত্য প্রদর্শন কিংবা কোনো ভাইরাল হওয়া ভিডিও বা গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো। কিছু দৃষ্টিশোভন, কিছু দৃষ্টিকটু। কিছু সহনীয়, কিছু অসহনীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই কোনো শিক্ষণীয় বার্তা। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রথম টিকটক দেখেছিলাম। ভোট কেন্দ্রের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের মুখে ‘খুশিতে, ঠেলায়, ঘোরতে’- এই কথাগুলো। যা অনুকরণ করে বিখ্যাত হয়েছেন অনেকেই। রাজনৈতিক বক্তৃতা-ওয়াজ অনুকরণ করেও টিকটক করছেন অনেকেই। জনপ্রিয় হওয়ার আশায় ইদানীং এসবের সঙ্গে কিছু কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, টিভি-সিনেমার নায়ক-নায়িকাও টিকটক তারকাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেক্ষেত্রে টিকটক তারকাদেরই বিজয় বলা যায়। কারণ এদের অনেকের চেয়ে টিকটক শিল্পীদের ফলোয়ার এবং জনপ্রিয়তা বেশি। বলাবাহুল্য, টিভি-সিনেমার এই তারকাদের অনেকেই অন্যের কুরুচিপূর্ণ-স্থুল সংলাপেও ঠোঁট মেলাচ্ছেন, নৃত্য করছেন। প্রশ্ন উঠছে, শিল্পীরা এসব করছেন নাটক, সিনেমায় জনপ্রিয়তার ঘাটতি পোষাতে নাকি অর্থ লাভের আশায়? ইদানীং টিকটকে নাকি অর্থও পাওয়া যায়। আবার অনেক প্রযোজক, নির্মাতা কিংবা অভিনয়শিল্পী নিজেই ভিউ বাড়াতে তাঁদের নিজস্ব নাটক থেকে স্থুল ও অশ্লীল সংলাপগুলোকে কাটপিস হিসেবে টিকটকে ছেড়ে দিচ্ছেন। ধরে নিলাম ভিউ বাড়ে কিন্তু মান কি বাড়ে? শুধু অশোভন পোশাক বা অশ্লীল সংলাপই নয়, ইদানীং টিকটক ব্যবহার করে মাদক বাণিজ্যও হচ্ছে।

আসলে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক কোনো মাধ্যমই খারাপ নয়। খারাপ হয় ব্যবহার দোষে। আর প্রযুক্তির এই অপব্যবহারেই বাড়ছে অপরাধ। বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার ও কিশোর অপরাধ। ফলে বাড়ছে সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা। আর এসব কারণেই বাড়ছে সামাজিক দূষণ। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে অভিভাবকদের পাশাপাশি বোদ্ধা সমাজ ও সরকারি নীতিনির্ধারকদেরও  আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

 

অসুস্থ কর্মকান্ড সমর্থন করা যায় না

রোবায়েত ফেরদৌস [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক]

অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে টিকটক- এই কথাটির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমাদের সুস্থ বিনোদন, উন্নত প্রযুক্তি দরকার। কিন্তু বিনোদনের নামে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে যা খুশি তাই করব এমন মানসিকতা একটি দেশ জাতি ও সমাজের মধ্যে চরম অবক্ষয় তৈরি করে দেয়। সুস্থ জাতি হিসেবে আমাদের সব সময়ই রুচির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অসুস্থ বিনোদন সৃষ্টির মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতি সৃষ্টি মানেই নৈতিকতাকে বিসর্জন দেওয়া। যা সভ্য জাতি হিসেবে কারও কাম্য নয়। এই টিকটক অপসংস্কৃতির মাধ্যমে নারী পাচার থেকে শুরু করে নানা অনৈতিক কর্মকান্ড দেশে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। এই অবস্থা রোধ করার জন্য রাষ্ট্র, আইন এবং সচেতন মানব সমাজকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সবাই সতর্ক না হলে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বিপন্ন হবে। যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। উন্নত প্রযুক্তি ও সুস্থ বিনোদন সবার কাম্য।  তবে এর নামে অসুস্থ কর্মকান্ডকে কখনো সমর্থন করা যায় না।

 

আত্মোপলব্ধি বাড়াতে হবে

অনুপম হায়াৎ [চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক]

টিকটকের নামে যে অসুস্থ ও বিকৃত বিনোদন ছড়িয়ে পড়ছে তা আমাদের জীবন ও সমাজবিরুদ্ধ। উন্নত প্রযুক্তির অপব্যবহার করে কোনো অনৈতিক কর্মকান্ড সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ফেসবুক, ইউটিউবসহ যোগাযোগমাধ্যমে এসব অসুস্থ তৎপরতা যারা করছে তাদের ভেবে দেখা দরকার দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের কি কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধ নেই? এদের রুখবে কে? রাষ্ট্র কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? কারণ রাষ্ট্র তো জনপ্রতিনিধি মানে আমাদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে মানুষের মধ্যে উৎকর্ষতা বাড়াতে হবে। না হলে কারও বোধোদয় হবে না। নিজের হাত যদি নিজেই আগুনে পুড়িয়ে দিই তাহলে নিজের ক্ষতি তো নিজেই করলাম। তাই নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, সচেতনতা, শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করতেই হবে। তা না হলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো অসম্ভব। প্রযুক্তি এখন মহাশূন্যে। তাই কোনো একটি দেশ চাইলেই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে পারবে না। প্রযুক্তির অপব্যবহারে ধর্ষণ, কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে।  এ জন্য প্রথমেই দরকার পারিবারিক কঠোরতা ও আত্মোপলব্ধি।

 

পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে হবে

হাবিবা রহমান [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও ফটোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষক]

টিকটক হচ্ছে মূলত ১৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ব্যাপ্তির নাচ, গান ও শিক্ষামূলক বক্তব্যপ্রধান একটি ভিডিও কনটেন্ট। কিন্তু আমাদের দেশে দেখতে পাচ্ছি কিশোর, যাদের ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি তারা টিকটকের নামে অসুস্থ বিনোদন গড়ে তুলছে। যদিও একটি শ্রেণির মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে কিন্তু তা হচ্ছে দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য নেতিবাচক ও ভয়াবহ। কিশোররা টিকটকের নামে চটুল বিনোদন তৈরি করছে। এতে আমাদের সুস্থ বিনোদন ও সংস্কৃতি ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে। নারী পাচার, কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠা, ধর্ষণসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ছে। এর জন্য কোমলমতি কিশোরদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। করোনাকালে ঘরে সঙ্গীবিহীন থেকে হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইলের মাধ্যমে তারা এমন অপসংস্কৃতি চর্চার দিকে অনবরত ঝুঁকছে। এ অবস্থা রোধে আগের দিনের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা সুস্থ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। কিশোরদের মনে সুকুমারবৃত্তি জাগিয়ে তুলতে হবে। আমার কথা হলো- টিকটক যদি সৃজনশীল বিনোদন না হয় তা হলে এটি কেন থাকবে। এটি প্রতিরোধে পারিবারিকভাবে সর্বত্র সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

সর্বশেষ খবর