শনিবার, ৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ?

পান্থ আফজাল

অভিমানী, তুমি কোথায় হারিয়ে গেছ?

সত্তর দশকের একেবারে শুরুতে লাকী আখন্দ, হ্যাপী আখন্দ, নিলু, মনসুর এবং সাদেককে নিয়ে এক স্বপ্নদ্রষ্টা গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল ‘উচ্চারণ’। তার পরের বছর বিটিভিতে তাঁর কণ্ঠে গাওয়া ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি সরাসরি প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। তবে ১৯৭৪ সালে ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে’ শিরোনামের সাড়া জাগানো গান গেয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক হইচই ফেলে দেন  কিংবদন্তি এই পপসম্রাট। সেই সময় ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং পিলু মমতাজের সঙ্গে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গানও করেন তিনি। তাঁকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো কিছুই নেই! তিনি বাংলা পপসংগীতের পথিকৃৎ, বীর মুক্তিযোদ্ধা পপগুরু আজম খান। দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলা সংগীত জগতের এই মহান পপতারকা। আজ এই পপগুরুর প্রয়াণ দিবস।

পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। কিন্তু মানুষ জানত আজম খান নামেই। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সালে ঢাকার আজিমপুরের ১০ নম্বর কলোনিতে জন্ম। তাঁর বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন। বসবাস করতেন বাবার কমলাপুরের বাড়িতে। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা বাবা, মা এবং চার ভাই ও এক বোনের সঙ্গে। বাবা ছিলেন সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯৬৮ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে বাণিজ্য বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর পড়ালেখায় অগ্রসর হতে পারেননি।

বাবার অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আজম খান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হেঁটে আগরতলায় চলে যান। তাঁর গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাত। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেন। “২০ আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর : ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্র্ধর্ষ যোদ্ধা।” শহীদজননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এভাবেই পপগুরু আজম খানকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশন তিতাস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) এবং হোটেল পূর্বাণীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। কারণ ওইসব হোটেলে অবস্থানরত বিদেশিরা যাতে বুঝতে পারে এ দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তাঁর বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন।

পপগুরু আজম খানকে গানের বাইরে মাঝে মাঝে দেখা গেছে অন্য ভূমিকায়। কখনো অভিনেতা, কখনো বা মডেল, কখনো আবার ক্রিকেটার হিসেবে। শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ নামের একটি ছবিতে নাম ভূমিকায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজম খান। পরবর্তীতে আরও ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেননি। এ ছাড়াও আজম খান মডেল হয়েছেন এনার্জি ড্রিংক আর বাংলালিংকের দুটি বিজ্ঞাপনচিত্রে। বিটিভির একাধিক নাটকে বাউল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।

ক্রিকেটার হিসেবে আজম খান তৈরি করে গেছেন এক অনন্য রেকর্ড। তিনি দেশের বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে ৪১ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটে আজম খান ছিলেন একজন অলরাউন্ডার। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন।

বাংলাদেশের প্রথম পপতারকা আজম খান। বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের অগ্রপথিক। তাঁর পথ অনুসরণ করে ব্যান্ড সংগীত বর্তমানে বাংলাদেশে একটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আজম খান ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন।

আজম খান ২০১০ সাল থেকে মুখগহ্‌বরের ক্যান্সারে ভোগেন।  দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে আজকের এই দিনে শেষ শয্যায় শায়িত  হন এই পপগুরু ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

 

আজম আমার অতুলনীয় এক বন্ধু

ফেরদৌস ওয়াহিদের স্মৃতির জানালায় কড়া নাড়তেই তাঁর মনে পড়ে গেল ১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা। তখন সিনেমা হলেও টিকিটের বিনিময়ে গানের অনুষ্ঠান হতো। তেমন এক অনুষ্ঠানে আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়ার কথা। সবই প্রস্তুত। কিন্তু বেঁকে বসলেন আজম খান। সেই দিনের ঘটনার কথা মনে করে ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, “জোনাকি সিনেমায় আমাদের একটা অনুষ্ঠান হবে। সবাই অনুষ্ঠানে যাব, ঠিক আগ মুহুর্তে আজম হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি যামু না। আমারে অন্যভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা কর।’ এরপর ওর জন্য গাড়ি আনা হলো, গেল না। রিকশা ডাকা হলো, তাও গেল না। সবাই মিলে ভাবলাম, একটা ভ্যানগাড়ি পাঠাই। ভ্যানগাড়ি দেখে আজম তখন বলে, ‘এইবার ঠিক আছে’। সত্যি সত্যিই সে ভ্যানগাড়িতে চড়ে অনুষ্ঠানের জন্য বের হয়।” এটা স্রেফ মজা করার জন্যই করেছে আজম। তবে সিনেমা হলে পৌঁছানোর আগেই সে নেমে যায়। কমলাপুর থেকে মতিঝিল থানা পর্যন্ত ভ্যানগাড়িতে আসে। তারপরের পথটা হেঁটেই গেছে।  এ ধরনের মজাগুলো আজম খুব করত। রসিকতা ও দুষ্টুমি করতে ওর ভালোও লাগত। এই স্মৃতি আমি কখনই ভুলি না। আজম আমার অতুলনীয় এক বন্ধু।

---ফেরদৌস ওয়াহিদ

সর্বশেষ খবর