সোমবার, ২৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সিনেমা হলের বেহাল দশা

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা হলের বেহাল দশা

‘সিনেমা হলের ভিতরে প্রবেশ করলে দুই চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরে। এমন দুরবস্থা কখনো দেখিনি। প্রজেক্টরসহ সব মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। সিট ঘুণপোকায় খাচ্ছে। লোহার কাঠামোতে জং ধরেছে। আমার মতো অনেকেরই প্রিয় সিনেমা হলের এমন দৈন্যদশায় সিনেমা হল মালিকরা কাঁদছেন, হাহাকার করছেন। কী করব বুঝতে পারছি না। হয়তো সিনেমা হলের ব্যবসা আর টিকিয়ে রাখা গেল না।’ এই কান্না আর আর্তনাদ যশোরের শার্শায় অবস্থিত ময়ূরী সিনেমা হলের কর্ণধার আশরাফুল বাবুর। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ময়ূরীর ছিল একসময় রমরমা অবস্থা। দর্শকমুখর হয়ে থাকত ৭০০ আসনের এই সিনেমা হলটি। কর্ণধার বাবু আক্ষেপ নিয়ে বলেন, সরকারের কাছে চেয়ে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। তিনি জানান, করোনার কারণে সিনেমা হল বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে স্টাফদের বেতনসহ নানা খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে।

করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশে গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ ছিল সিনেমা হল। এরপর ছবির অভাবে বেশির ভাগ সিনেমা হলই রয়েছে বন্ধ। বর্তমানে দেশে ৬০টির মতো সিনেমা হল লোকসান গুনে খোলা রেখেছেন মালিকরা। আয় না থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। গত ঈদে নতুন একটিসহ বেশ কটি পুরনো ছবি মুক্তি দেওয়া হয়। করোনার কারণে বর্তমানে সিনেমা হল বন্ধ রাখার ব্যাপারে সরকারের কোনো নির্দেশ না থাকলেও ঈদ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত জেলা প্রশাসকরা ঢাকাসহ নানা স্থানে সিনেমা হল বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে। মধুমিতা সিনেমা হলসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা হল গত ২৫ জুন খুলতে চাইলেও জেলা প্রশাসন খুলতে দেয়নি। মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ জানান প্রতি মাসে স্টাফ বেতনসহ নানা খরচ চালাতে লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তাঁকে। করোনায় ছবি মুক্তি না পাওয়া ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ও ছবি যখন পাওয়া যায় না তখন ছবির এই অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনে ভারতের ছবি একই সঙ্গে এখানে মুক্তির ব্যবস্থা করলে অথবা যৌথ প্রযোজনা নিয়মিত হলে কিছুটা আশার আলো দেখা যেতে পারে। প্রদর্শক সমিতি জানায়, এভাবে চলতে থাকলে খোলা সিনেমা হলগুলোও স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রায়েরবাজারের মুক্তি সিনেমা হলে কাজ করেন ২২ জন কর্মচারী। হলটির ব্যবস্থাপক শহিদুল্লাহ বলেন, বেতন কীভাবে চালিয়ে যাবে সেই চিন্তায় অস্থির কর্তৃপক্ষ। মিরপুরের পূরবী হলের ম্যানেজার পরেশ জানান, তাঁদের হলে মোট ৩২ জন কর্মচারী কাজ করেন। ব্যবসা না থাকলে মালিকের পক্ষে বেতন দেওয়া কীভাবে সম্ভব? রংপুরের শাপলা হলের ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে হল খুললেও দর্শক আসবে বলে আমার মনে হয় না। এ হলে ২২ জন কর্মচারী ফুলটাইম চাকরি করেন। যশোরের মণিহার প্রেক্ষাগৃহের হিসাবরক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমরা ৩২ জন কাজ করি। মালিকপক্ষ ভর্তুকি দিয়ে হল চালাত। বেতন দেওয়া হতো আমাদের মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারের আয় থেকে। এখন করোনার কারণে তাও প্রায় বন্ধ। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেসে কাজ করেন ১৫ জন, ঝুমুর হলে ১২ জন। তাদেরও নিয়মিত বেতন দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান প্রেক্ষাগৃহ দুটির ম্যানেজার সাইফ হোসেন।

লোকসান গুনে বন্ধ করে দেওয়া ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘অভিসার’-এর কর্ণধার সফর আলী ভূঁইয়ার কথায়, প্রতি মাসে ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। এভাবে আর কতদিন। তাই বাধ্য হয়ে গত বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হাজার আসনের অভিসার। তিনি জানান, একসময় এটি ছিল উন্নত জীবন ধারণের ব্যবসা। মাসে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা নিট মুনাফা হতো। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক না আসায় বছরের পর বছর লোকসান গুনে যাচ্ছি। সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করলেও ‘সিনেমা হল’ শিল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সিনেমা হলে এখনো বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হয় শিল্প হারের পরিবর্তে বাণিজ্যিক হারে। চলচ্চিত্রকে ‘শিল্প’ ঘোষণার পর এটি কোনোভাবেই হতে পারে না। ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের কর্ণধার কলিমুল্লাহর কথায় ২৫ জনের মতো স্টাফ আর বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় লাখ লাখ টাকার খরচ আর কতদিন এভাবে বেকার বসে বসে চালাব। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য এই সিনেমা হলটি করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সব যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, আসন নষ্ট হয়ে গেছে। সিনেমা হলটি সংস্কারের টাকা কোথায় পাবেন তিনি জানেন না। সরকারের কাছে সিনেমা হলের জন্য কোনো সহযোগিতা চেয়ে কখনো পাওয়া যায়নি বলেও তাঁর ক্ষোভ। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত হাজার আসনের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘উর্বশী’র অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে বলে জানান এর কর্ণধার খুরশিদ আলম। তিনি বলেন, মেশিন থেকে শুরু করে সবকিছুই তো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ১৫ জন স্টাফসহ খরচ প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। সিনেমা হল বন্ধ করে এখানে গোডাউন বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতাম। তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আগে সিনেমা হল বাঁচান, সিনেমা হল বাঁচলে সিনেমা শিল্প বাঁচবে। না হলে এই শিল্পের অস্তিত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না।’

খুরশিদ আলমের কথায় সিনেমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী-কলাকুশলী, নির্মাতারা বড় পর্দায় কাজ না থাকলেও ছোট পর্দা বা এখনকার নানা ওয়েব প্ল্যাটফরমে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন কিন্তু সিনেমা হল মালিকদের তো আয়ের আর কোনো পথ নেই। তাই তাঁরাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চলতি বছর বগুড়ার ধুনটের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘সিকতা’ বন্ধ হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বন্ধ হয় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘আলমাস’ ও ‘দিনার’। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে ভাঙা হয় রাজধানীর ‘রাজমণি’। প্রদর্শক সমিতির হিসাবে দেশে বর্তমানে সিনেমা হলের সংখ্যা মাত্র ৬০টির মতো। ২০০০ সালের দিকেও যে সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০। সিনেমা হল মালিকদের হাহাকার- ‘আর কত লোকসান গুনব? আমরা তো পথে বসে গেছি। মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাবে দর্শক নেই। অথচ প্রতি মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ট্যাক্স, বিদ্যুৎ ও পানির বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকের লোনও অনেককে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে আর কতদিন চালানো যায়। সরকার তো শুধু ঘোষণা দিয়েই শেষ। এর আগে সিনেমা হলে সরকারি উদ্যোগে প্রজেক্টর স্থাপনের কথা বলা হলেও দীর্ঘ কয়েক বছর কেটে গেছে, প্রজেক্টরের দেখা নেই। ৬৪টি জেলায় সরকারি উদ্যোগে সিনেপ্লেক্স স্থাপনের কথা থাকলেও কয়েক বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

বন্ধ সিনেমা হল চালু, সংস্কার ও নতুন সিনেমা হল  তৈরিতে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদে ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার গত বছরের অক্টোবরে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সেই ঘোষণা বস্তবায়নের দেখা নেই। গত বছরের শেষদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে একটি সার্কুলার জারি করলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো বাস্তবায়নের লক্ষণ নেই বলে চরম ক্ষোভ এখন  সিনেমা হল মালিকদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর