শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রের শেষ ভরসা কি ওটিটি

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রের শেষ ভরসা কি ওটিটি

চলচ্চিত্র মুক্তির শেষ ভরসাস্থল কি অনলাইন প্ল্যাটফরম ওটিটি হতে যাচ্ছে, এমন প্রশ্ন এখন চলচ্চিত্রের সিনিয়র নির্মাতা ও দর্শকের। কারণ বর্তমানে অনেক প্রযোজক করোনাতান্ডবে সিনেমা হলে ছবি মুক্তি দিতে সাহস হারিয়ে বিকল্প হিসেবে অনলাইন প্ল্যাটফরমের কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যেই দেশীয় কয়েকটি অনলাইন চালু হয়েছে এবং প্রচুর অনলাইন চালুর পথে রয়েছে। এক্ষেত্রে বিগ বাজেটের ছবিগুলো যদি অনলাইনে মুক্তি দিয়ে কমপক্ষে নির্মাণ ব্যয় তুলে আনা যায়, তাহলে ওটিটির দিকেই নির্মাতারা ঝুঁকবেন বলে তাঁরা বলছেন। অনেক প্রযোজকের যুক্তি- ‘নানা কারণে দর্শক এখন সিনেমা হলবিমুখ। তারা ঘরে বসেই ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সিনেমা হলের পরিবর্তে ওটিটিতেই ছবি মুক্তি দেওয়া শ্রেয়। তাঁদের কথায় অনলাইন প্ল্যাটফরমের দর্শক বেড়েই চলেছে। শুধু দর্শক নয়, শিল্পীরাও এখন অনলাইনের ছবি বা সিরিজ করতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনেকের কথায় অনলাইন প্ল্যাটফরম এখন সময়ের চাহিদা। তাই ছবি মুক্তি দিতে অনলাইনের পথেই হাঁটা শুরু করতে হবে। আর এই পথে হেঁটে চেষ্টা চালাতে হবে চলচ্চিত্রের হারানো বাজার ফিরিয়ে আনার। পাশাপাশি সিনেমা হলকে একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ ছবি দেখার স্বাচ্ছন্দ্যের একমাত্র স্থান হলো সিনেমা হল। এর কোনো বিকল্প নেই। তাই সিনেমাকেন্দ্রিক ব্যবসা যেন দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টাও করতে হবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদ বলেন, বর্তমানে করোনাকালে অনলাইনই ছবির মুক্তির বিকল্প ভরসাস্থল। তবে এটিকে আমি স্থায়ী সমাধান মনে করি না। কারণ ওটিটি হলো ডিভাইস ও সিনেমা হল হচ্ছে বিগ স্ক্রিনকেন্দ্রিক দেখার মাধ্যম। সিনেমা হলের বিগ স্ক্রিনে পরিবারসহ দর্শক ছবি দেখে যে স্বাচ্ছন্দ্য পায় তা ঘরে বসে অনলাইনে পাওয়া সম্ভব নয়। এর উদাহরণ হচ্ছে বিশ্বে অনেক আগেই অনলাইনে ছবি দেখার প্রচলন শুরু হয়েছে। তারপরও দর্শক কিন্তু ব্যাপক হারে সিনেমা হলেই যাচ্ছে। অনেকে বলেন সিনেমা হলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে অনলাইন প্ল্যাটফরম। যদি তাই হতো তাহলে যখন থেকে আকাশ সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তখনই সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেত। এসব হচ্ছে ঘরোয়া বিনোদের নতুন মাধ্যম এবং অস্থায়ী। ছবি দেখার মূল মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা হল। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলীমউল্লাহ খোকন বলেন, যেহেতু এখন করোনা ও নানা কারণে সিনেমা হল বন্ধ বা দর্শক ভয়ে সেখানে যেতে চাচ্ছে না তাই সাময়িকভাবে এই নতুন মাধ্যমটির মাধ্যমে তারা ঘরে বসে ছবি দেখবে। কিন্তু ছবি দেখার পরিপূর্ণ আমেজ নিতে দর্শক সবসময়ই সিনেমা হলমুখী হয়েছে এবং হবেই। আরেকটি কথা হচ্ছে পৃথিবীতে সব ব্যবসারই মাঝে মধ্যে ধরন বদল হয় কিন্তু মূল ধরনটি ঠিকই থাকে। তাই আমি মনে করি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মূল স্থল হিসেবে সিনেমা হলের কোনোই বিকল্প নেই। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, সিনেমা হলের বিকল্প কখনোই ডিজিটাল প্ল্যাটফরম নয়। তবে এখন কিছু কিছু প্রযোজক হয়তো এমন উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাও অর্থনৈতিক চাপে পড়ে। তিনি যে টাকা লগ্নি করে গত ৫-৬ মাস ধরে বসে আছেন, সেখান থেকে তো কোনো অর্থ রিটার্ন আসছে না। এই অর্থ সংকটের চাপের কারণেই হয়তো ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে নির্মিত সিনেমাটি মুক্তির চিন্তাভাবনা করছেন, হয়তো কেউ দুয়েকটা ইতিমধ্যেই রিলিজ করেও থাকতে পারেন। তবে এটা নিতান্তই অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই। মানে দীর্ঘদিন টাকা লগ্নি করে বসে থাকা যে কারো জন্যই বিরাট ক্ষতির। যাঁরা অনলাইন প্লাটফরমে যাচ্ছেন, তাঁরা সেই ক্ষতিটা আর বাড়াতে চাচ্ছেন না। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, দীর্ঘদিন একটি ছবি নির্মাণ করে ফেলে রাখলে নানা কারণে ছবিটির মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। তৈরি ছবি বেশি দেরিতে মুক্তি দিলে সেটি পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে দর্শকগ্রহণযোগ্যতা হারায়। তাই হয়তো নির্মাতার মুক্তির বিকল্প চিন্তা করতে পারেন। কারণ এখন বিশ্বব্যাপী অনলাইনেও ছবি মুক্তি পাচ্ছে। তাই বলে সিনেমা হলের আবেদন কোথাও ফুরিয়ে গেছে বা যাবে এমনটি ভাবার কোনো যুক্তি নেই। চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের মতে এখন ডিজিটাল কনটেন্টের যুগ। বাংলাদেশও এখন পিছিয়ে নেই। স্ট্রিমিং খাতে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে, ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরমগুলোর জনপ্রিয়তা এত বেশি বেড়েছে যে, এখন কীভাবে এসব ডিজিটাল পরিষেবায় আরও বেশি মানুষকে যুক্ত করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তথ্যানুসারে, এই জাতীয় প্ল্যাটফরমগুলোর জন্য ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথ দেশে ব্যবহৃত মোট ব্যান্ডউইথের প্রায় ৪০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মিডিয়া রিসার্চ এজেন্সি কানটারের মতে, ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই পরিষেবাগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের দেশে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং সেবাগুলোর দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ২০১০ সালের দিকে মাত্র ২ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করতেন। অথচ এখন টিভি সেটের সামনে না বসে হাতে থাকা মোবাইল ফোনেই তার পছন্দের শো, মুভি, নাটক, খেলা দেখে নিচ্ছেন। এখানে শুধু তরুণেরাই নয়, সব বয়সী মানুষকেই টানছে স্ট্রিমিং সেবা। বাংলাদেশে নেটফ্লিক্স স্ট্রিমিং শুরুর পর সচ্ছল দর্শকদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা দেখা যায়, টরেন্ট সাইট থেকে অবৈধভাবে ডাউনলোড করে সিরিজ আর ফিল্ম দেখার ডামাডোলে বৈধ উপায়ে মৌলিক প্রযোজনা দেখার আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সময় অ্যামাজন প্রাইম এতে নতুন  বৈচিত্রের মাত্রা যোগ করে। দেশের বাজারে বঙ্গ, বায়োস্কোপ, আইফ্লিক্স, পরবর্তীতে হইচই ও এয়ারটেল টিভি প্লাস ওয়েব সিরিজ, মৌলিক ওয়েব প্রযোজনা নিয়ে এ দশকেই মাঠে নামে। তারপরও দিনশেষে বলতে হয় চলচ্চিত্র দেখার প্রধান এবং আনন্দদায়ক মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা হল, যার কোনো বিকল্প নেই বা হবে না, এমন আত্মপ্রত্যয়ী কথা চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের।

সর্বশেষ খবর