বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

সিনেমা হল কি আর খুলবে!

আলাউদ্দিন মাজিদ

সিনেমা হল কি আর খুলবে!

কেন বন্ধ শুরু

নব্বই দশকের শেষভাগ থেকেই অশ্লীলতা, নকল আর পাইরেসি দর্শকদের সিনেমা হল ছাড়তে বাধ্য করেছে। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক না থাকায় বছরের পর বছর লোকসান গুনে বাধ্য হয়ে সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে নব্বই দশকের শেষভাগে থাকা প্রায় ১৪০০ সিনেমা হলের মধ্যে এখন একশরও নিচে এসে ঠেকেছে। সিনেমা হল বন্ধের শুরুটা হয় ১৯৯৫ সালে। ওই বছর রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ‘গুলিস্তান’ ও ‘নাজ’ সিনেমা হল ভেঙে শপিং মল তৈরি করা হয়। তারপর দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত চলছে এই ভাঙা আর বন্ধের ধারাবাহিকতা। শুধু ঢাকার সিনেমা হলের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে ঢাকায় ছিল ৪৪টি সিনেমা হল। এখন বন্ধ আর খোলা অবস্থায় সিনেমা হল হিসেবে অস্তিত্ব আছে ২৪টির।

 

খুললে চলবে তো

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ বলেন, সিনেমা হল চলার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। এর জন্য প্রয়োজন মানসম্মত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ছবি। ওটিটি এবং উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি সিনেমা হলে দর্শক আগমনের অন্তরায় হয়ে আছে। তবে ভালো ও পর্যাপ্ত পরিমাণ ছবি পেলে সিনেমা হলের ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ বিশ্বের অনেক দেশে বহু আগে থেকেই ওটিটি এবং উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ছিল কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ ও মানসম্মত ছবির কারণে সিনেমা হলের ব্যবসায় ধস নামেনি।

 

করোনায় ক্ষতি

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ বলেন, করোনার কারণে গত প্রায় দুই বছরে সিনেমা হলের ব্যবসার ক্ষতি প্রায় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই ক্ষতি অপূরণীয় বলে জানান প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল।

 

গত এক মাসে বন্ধ

গত ১ মাসে বন্ধ হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে এমন সিনেমা হলের মধ্যে রয়েছে নেত্রকোনার ‘হীরামন’। এ জেলার সাতটি সিনেমা হলের মধ্যে অবশিষ্ট ‘হীরামন’ সিনেমা হলটি এখন ভাঙা হচ্ছে। লক্ষীপুরের ‘হ্যাপী’ সিনেমা হলের ভাঙার কাজও চলছে। চালনার ‘নিউ রজনী গন্ধা’ সিনেমা হলটিও ভাঙা হচ্ছে। এমন অসংখ্য সিনেমা হল ভাঙা হচ্ছে যা সব সিনেমা হল মালিক সমিতিকে জানান না, বললেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ।

 

বর্তমানে কয়টি খোলা

প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীন জানান, সরকারি হিসাবে দেশে এখন ৯২টি সিনেমা হল চালু আছে। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, লোকসানের কারণে অধিকাংশ সিনেমা হলের মালিক অনেক দিন ধরে সিনেমা হলের লাইসেন্স নবায়ন করছেন না। ফলে সরকারি হিসাবের তালিকায় সেসব সিনেমা হলের নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না।

 

বন্ধ সিনেমা হল এখন

কেউ সিনেমা হল বন্ধ করে ফেলে রেখেছেন কেউবা ওই স্থানে গড়ে তুলেছেন নানা স্থাপনা। শুধু ঢাকার বন্ধ সিনেমা হলের স্থলে এখন কি আছে সেই চিত্রটি হলো- গুলিস্তানের গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হল হয়েছে শপিং মল, কারওয়ান বাজারের পূর্ণিমা সিনেমা হল হয়েছে শপিং মল, মিরপুর গাবতলীর এশিয়া সিনেমা হল হয়েছে ফু-ওয়াং ক্লাব, ওয়াইজঘাটের স্টার সিনেমা হল এখন স্টার মার্কেট, ওয়াইজঘাটের মুন সিনেমা হল এখন মার্কেট, মিরপুরের বিউটি সিনেমা হল এখন মার্কেট, সদরঘাটের রূপমহল এখন মার্কেট, মৌলভীবাজারের তাজমহল সিনেমাও এখন মার্কেট, ইসলামপুরের লায়ন সিনেমাও এখন মার্কেট, আর্মানিটোলার শাবিস্তান সিনেমা হল এখন গোডাউন, বংশালের মানসী সিনেমা হলের নিচ তলা এখন মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা সিনেমা হল এখন শপিং মল, গুলশানের জ্যোতি সিনেমা হল এখন মার্কেট, ক্যান্টনমেন্টের সাগরিকা সিনেমা হল এখন কমিউনিটি সেন্টার, ক্যান্টনমেন্টের গ্যারিসন সিনেমা হলটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, বাসাবোর আগমন ও অতিথি সিনেমা হলের স্থানে এখন রয়েছে স্বপ্ন চেইনশপ ও আড়ংয়ের শোরুম, পোস্তাগোলার ডায়না, যমুনা ও মেঘনা সিনেমা হল ভেঙে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ক্লিনিক, কাকরাইলের রাজমণি হল ভেঙে নির্মাণ করা হচ্ছে শপিং মল ও বাণিজ্যিক ভবন। ঢাকার বাইরে সারা দেশেও কিন্তু একই চিত্র।

 

বন্ধ করা যায় কি

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, কোনো সিনেমা হল মালিক যদি সিনেমা হল বন্ধ করতে চান তাহলে তাঁকে এনবিআরকে লিখিতভাবে তা জানাতে হয়। সিনেমা হল বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। এরপর আবার যদি কোনো মালিক নতুন করে সিনেমা হল চালু করতে চান তাহলে তাঁকে আবার নতুন করে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়।

 

ধরন বদলাতে হবে

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, পর্যাপ্তসংখ্যক ও মানসম্মত ছবি নেই, তাই সিনেমা হলের ধরন বদলাতে হবে। বিশাল জায়গাজুড়ে প্রায় হাজার আসনের সিনেমা হল রাখার কোনো অর্থ নেই। এখন সিনেমা হলগুলো ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে হবে। সেই বাণিজ্যিক ভবনে থাকবে ২০০ থেকে ৩০০ আসনের একাধিক সিনেমা হল। কিন্তু সিনেপ্লেক্স নয়, কারণ সিনেপ্লেক্সে ব্যয় বেশি, টিকিটের দামও বেশি। তাই মালিকপক্ষ এবং দর্শক দুইয়ের জন্যই তা অনুকূল হবে না। সাধারণ দর্শক উচ্চমূল্যে টিকিট কিনে ছবি দেখতে পারবে না। মফস্বলের সাধারণ দর্শকও সিনেপ্লেক্সে বেশি দামের টিকিটে ছবি দেখবে না। রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির আরেক সাবেক সভাপতি ইফতেখারউদ্দীন নওশাদ বলেন, ছবিই তো নেই। ছবি ছাড়া এত বড় সিনেমা হল রেখে লোকসান গনার কোনো মানে আছে? বর্তমান কাঠামো বদলে কয়েকটি ২০০ থেকে ৩০০ আসনের করে সিনেমা হল নির্মাণ করব। নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার সাথী সিনেমা হলের মালিক চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, বর্তমানে অনলাইনে ছবি মুক্তির কালচার শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সিনেমা হলের দর্শক আরও কমে যাচ্ছে। তাই আমিও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ছোট পরিসরে মানে ২০০ থেকে ৩০০ আসনের একাধিক সিনেমা হল গড়ার পক্ষে।

 

ঘোষিত ঋণ দ্রুত দিতে হবে

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, সরকার গত বছর সিনেমা হলের উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার ঋণের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা প্রথম ধাপে দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা পাওয়া যায়নি। সরকার যদি সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে এবং এর সুদ ৪ পার্সেন্টের পরিবর্তে ২ পার্সেন্ট করে দিয়ে ২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি সময়ে পরিশোধের সুযোগ দেয় তাহলে সিনেমা হল আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

 

৩০০ সিনেপ্লেক্স দাবি

চলচ্চিত্র নির্মাতা হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, ঢাকা শহরে সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বেশি নয়। সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা যখন বাড়বে তখন প্রতিযোগিতা চলবে। দর্শক ধরে রাখতে টিকিটের মূল্যও কমবে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে দুই-একটি আছে। সিনেপ্লেক্স ছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবসা ধরে রাখা যাবে না। বর্তমানে এটা উচ্চাভিলাষ নয়, যুগ ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, তাই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বেহাল দশা। এ অবস্থায় সরকারই পারে সহযোগিতা করতে। সরকারের কাছে দাবি ৩০০ সংসদীয় আসনে ৩০০ সিনেপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করে দিন। তাহলেই সিনেমা ব্যবসার সুদিন ফিরবে।

 

সিনেবোদ্ধারা যা বলেন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক জুনায়েদ হালিম বলেন, দেখার উপযোগী ছবি তেমন হচ্ছে না। দর্শকদের ওপর সিনেমা হলে না যাওয়ার দায় চাপানো যাবে না। যানজট ঠেলে সময় আর অর্থ নষ্ট করে কেন সিনেমা হলে ছবি দেখতে যাবে। আগে ছবি দেখার জন্য সিনেমা হল ছিল একমাত্র স্থান। এখন মোবাইল ফোন, নেট, স্যাটেলাইট চ্যানেলসহ নানা মাধ্যমে ছবি দেখা যায়। এতে বড় পর্দায় ছবি দেখার মজা না পেলেও মিনি ফরম্যাটে দেখে পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। মানে প্রযুক্তিগত কারণে যন্ত্রপাতি, দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন এসব মাধ্যমের কারণে একটি ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোর কাটাতে সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে ৪-৫টি স্ক্রিন থাকছে তাতে ৪-৫টি ভিন্ন মুভি চলছে। এতে দর্শক তার রুচিমতো ছবি বেছে নিতে পারছেন। তাই মাল্টিপ্লেক্স বাড়ানো দরকার। সিনেপ্লেক্স নির্মাণের জন্য সরকার যদি ঋণ দেয় বা প্রাইভেট খাতেও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বিনোদনের জন্য এটি হবে একটি রেভ্যুলেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা হলের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। একই সঙ্গে ভালো ছবি, গল্প আর নির্মাতার অভাব তো রয়েছেই। এখন ছবি দেখার নানা মাধ্যম রয়েছে। তাতে বিশ্বের সব ছবি দেখতে পারছেন মানুষ। অপশন যখন বেশি তখন প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার। পুরনোদের নিয়ে এখনো আমরা আটকে আছি। নতুনদের স্বাগত জানাতে হবে। সিনেমা হলে দেশির পাশাপাশি বিদেশি ছবিও চালানো উচিত। উপমহাদেশীয় ছবিকে গত ৫০ বছর ধরে প্রোটেকশন দিয়ে কি আমাদের শিল্পের কোনো উন্নতি হয়েছে? সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে নির্বাচনী বোর্ড গঠন করে দেশ-বিদেশের ছবি বাছাই করে প্রদর্শন করতে হবে। দর্শক ফেরাতে গল্প, চিত্রনাট্য, শিল্পী, নির্মাতা এবং ক্যামেরায় চোখ রাখার অভাব দূর করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারপারসন হাবিবা রহমান বলেন, বেশির ভাগ সিনেমা হলের পরিবেশ দর্শক উপযোগী নয়। সিনেমা হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর ও সৃজনশীল মাধ্যম। সিনেমা বড় পর্দায় দেখার বিষয় বলে বড় পর্দায় দেখার সুষ্ঠু অবস্থা ফেরাতে হবে। সিনেমা হল ভেঙে কেন শপিং মল নির্মাণ হবে। সিনেমা হলের পাশাপাশি সিনেপ্লেক্সও বাড়াতে হবে এবং ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর