সোমবার, ১৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের সংগীতাঙ্গন

কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের সংগীতাঙ্গন

কয়েক বছর ধরে সংগীতের অবস্থা এমনিতেই বেশ নাজুক। তার ওপর গত বছর করোনা মহামারী পুরোপুরি এলোমেলো করে দেয় এ অঙ্গনকে। এখন বেশির ভাগ গান প্রকাশ হচ্ছে ইউটিউবসহ নানা ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে। এখন গানের ভালো-মন্দের মাপকাঠি যেন ভিউর পেছনে ছুটছে। ভাইরাল আর কোটি কোটির ভিউতে টালমাটাল আমাদের সংগীতাঙ্গন। আসলে কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের সংগীতাঙ্গন।  এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের বেশ কজন গুণী। আর তা তুলে ধরেছেন - আলী আফতাব

 

আধুনিকতার কারণে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে :

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত গান নিয়ে নির্মাতারা রীতিমতো গবেষণা করতেন। গানের কারণে সিকুয়েন্স হতো। এখন বলা হয় সিচিউশনের জন্য গান দরকার। এটি আসলেই অবক্ষয়। এখন লেখা, সুর দেওয়া আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। এক্ষেত্রে ব্যাকরণের ধার ধারা হচ্ছে না। তাই গানের স্থায়িত্ব বা মান বলে কিছুই থাকছে না। তা ছাড়া এখন সবকিছুই আধুনিক হয়ে পড়ছে। এই আধুনিকতার কারণে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন ভালো হলে তাকে মন্দ বলব না। কিন্তু সংগীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে।

 

ইউটিউবে আমার হাজার হাজার গান কারা আপলোড করছে :

সাবিনা ইয়াসমিন

খুব অস্থির একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। সংগীতে একটা টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। শিল্পীদের কোটি টাকা সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে? কারা খাচ্ছে আমি জানি না? ইউটিউবে আমার হাজার হাজার গান আছে, কোনো কিছুই জানি না কারা আপলোড করছে? রয়্যালিটির টাকা মেরেকেটে না খেলে কি আমাদের কারও কাছে হাত পাততে হয়? অন্যদিকে একদল শিল্পী ছুটছেন কোটি ভিউয়ের পেছনে। কোটি ভিউয়ের সঙ্গে ভালো গানের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি বেশ কিছু কোটি ভিউ পার হওয়া গান শুনলাম, দেখলাম। একটাও ভালো গান নয়। কিন্তু কোটি ভিউ! বেশির ভাগ মানুষের নজর সস্তার দিকে যায় বেশি।

 

এখন এক বসায়ই গান গেয়ে ফেলা হচ্ছে :

খুরশীদ আলম

গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেয় না। সাধনাও করে না। তাই শুধু চলচ্চিত্রের গান নয়, সব গানই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাসও সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। আর এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসায়ই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই এসব গান আর প্রাণ ছুঁতে পারছে না। মানে আঁতুড়ঘরেই গানের মৃত্যু হচ্ছে। এখন একেবারেই যে ভালো গান হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এর পরিমাণ নিতান্তই স্বল্প। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। একসময় চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এই অবস্থার জন্যই চলচ্চিত্রের গানের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণে ওই যে বললাম গুরুর দীক্ষা আর সাধনা অত্যন্ত জরুরি।

 

গানকে জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে :

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

সংগীত হচ্ছে আত্মার খোরাক। মানুষের ভিতর যতদিন আত্মা ও হৃদয় থাকবে ততদিন সংগীত থাকবে। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না, আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া যায় না- সেই গান অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী। অমরত্বের জন্য গানকে হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে রচনা করতে হবে। কারণ সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। গান একসময় ছিল জীবনমুখী ও নৈতিকতাপূর্ণ। গল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, মাখামাখিপূর্ণ। সেই গান মানুষের হৃদয়কে দোলা দিত, তাড়িত করত। সে অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে গানকে আবারও জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে।

 

এখনকার শিল্পীরা ভাইরাল হতে চায় :

শেখ সাদী খান

 এখনকার কিছুসংখ্যক শিল্পী গান করেন শুধু নিজের পরিচিতির জন্য। আর তাদের মধ্যে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যারা অন্যের গান গেয়ে ভাইরাল হচ্ছেন তারা হয়তো শুধু পরিচিতি পাওয়ার জন্যই এটা করছেন। লোকে তাদের জানবে, চিনবে এমন ধারণা থেকেই ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যদি নিজস্বতা না থাকে পরবর্তীতে গানের জগতে তার টিকে যাওয়ার নজির নেই। যারা অন্যের গান গেয়ে ভাইরাল হতে চাইছেন, তাদের বলি : নিজস্বতা তৈরী হলে, নিজের পরিচয়ে পরিচিতি পেলে তার গান যদি ভাইরাল হয় তাহলে তার উপকারে আসবে। অন্যথায় অন্যের গান গেয়ে ভাইরাল হয়ে দুনিয়া জয় করে ফেললেও কোনো কাজে আসবে না।

 

এখনকার ছেলেমেয়েরা গানের ইতিহাস জানে না :

কুমার বিশ্বজিৎ

এখনকার গানের মূল আবহটাই পাল্টে গেছে। একটা সময় আমরা ভালোবেসে, মমতা দিয়ে গান গাইতাম। শ্রোতারা শুনতো হৃদয় দিয়ে। তারা গানকে অনুভব করত। চোখ বন্ধ করে গানের সুর ও ভাষা গ্রহণ করত। এখন সবাই গান শোনার চেয়ে দেখে বেশি। বর্তমান সময়ের বড় সমস্যা হচ্ছে গানের ভাষা। ভাষাগত দুর্বলতা গানের আবেদন নষ্ট করে দিচ্ছে। তবে একেবারেই যে ভালো গান তৈরি হচ্ছে না, তেমনটি বলা যাবে না। বাংলা গানে যা সৃষ্টি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। আমরা এখন পুরনো বাংলা গানকে আশ্রয় করে টিকে আছি। বিভিন্ন কারণেই গানে নতুনত্ব নিয়ে হাজির হতে পারছি না। এখনকার ছেলেমেয়েরা গানের অতীত ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে না। রয়েছে ভাষা জ্ঞানের অভাব, গীতিকবিদের অভাব, সিনিয়র শিল্পীদের সঙ্গে নতুন শিল্পীদের যোগাযোগ রক্ষা না করাসহ অনেক কারণ। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, একজন শিল্পী নিজেই গান লিখছেন, নিজেই সুর দিচ্ছেন। আবার সেই গান নিজেই পরিবেশন করছেন। এভাবে সৃজনশীলতা আসে না। সংগীত হচ্ছে সম্মিলিতভাবে চর্চার বিষয়। গান নিয়ে সাধনা করতে হয়। গানের কথায় মমতা থাকতে হয়, বার্তা থাকতে হয়। তবেই না বাংলা গানের রসবোধ শ্রোতারা আহরণ করতে পারবে। সত্যি বলতে, এসব নিয়ে অনেক কথাই বলেছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভবিষ্যতে কতটুকু হবে তাও জানি না।

 

একটা ভালো গানের জন্য ভালো শ্রোতাও লাগে :

ফাহমিদা নবী

সংগীতের একটি অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এখন শুধু ভালো গান তৈরি করলেই হবে না, ভালো গানের শ্রোতাও তৈরি করতে হবে। সত্যিকার অর্থে যারা ভালো গান লেখেন, সুর করেন তারা হাজার চেষ্টা করলেও বাজে জিনিস তৈরি করতে পারবেন না। সম্ভবই নয়। রুচিতে বাধবে। একজন ভালো সুরকার প্রথমেই চিন্তা করবেন যেন গানটা চিরজীবী হয়। সহজে কিন্তু হীরা খুঁজে পাওয়া যায় না। হীরা খুঁজে পাওয়া কিন্তু অনেক কঠিন। সুতরাং এটা নিয়ে আমার আসলে বেশি কিছু বলার নেই। কোটি ভিউ দিয়ে কোনো দিনই বিচার করা যাবে না যে, কোটি ভিউ হলেই ভালো গান হবে।

সর্বশেষ খবর