বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে তারকা শিল্পী তৈরি হচ্ছে না কেন

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে তারকা শিল্পী তৈরি হচ্ছে না কেন

নায়করাজ খ্যাতি পেয়েছিলেন রাজ্জাক। এই খ্যাতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ কাজের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা আর অপরিসীম দক্ষতা। এভাবেই কাজপাগল শিল্পীরা একসময় হয়ে ওঠতেন তারকা। বর্তমান সময় ‘তারকা’ শব্দটিই যেন হারিয়ে গেছে।

বলতে গেলে নব্বই দশক পর্যন্ত যেসব শিল্পীর চিত্রজগতে আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই অল্প সময়ে তারকা হয়ে উঠেছিলেন। ছবির দৃশ্য-গল্পের সঙ্গে মিশে যেতেন তাঁরা।  কেবল সিনেমার কাহিনি নয়, শিল্পীদের অভিনয় আর মন মাতানো গানও দর্শকের মনে গেঁথে যেত। এখন নায়করাজ রাজ্জাক, ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা, মেগাস্টার উজ্জল, সুপারস্টার মিয়াভাই ফারুক, হ্যান্ডসাম হিরো আলমগীর, রাফ অ্যান্ড টাফ জসিম, লাভার বয় জাফর ইকবাল, হি-ম্যান হিরো ওয়াসিম, মহানায়ক বুলবুল আহমেদ, বিউটি কুইন শাবানা, মিষ্টি মেয়ে কবরী, ইন্টারন্যাশনাল ট্যালেন্ট ববিতা, ড্রিমগার্ল সুচরিতা, মমতাময়ী আনোয়ারা, ঢাকাই চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাট আনোয়ার হোসেন, সাফল্যের বরপুত্র সালমান শাহ, কমেডি কিং টেলিসামাদ, মতি, দিলদারদের মতো কালজয়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী-শিল্পী  তৈরি হচ্ছে না আর। গত দুই দশকে বাংলা চলচ্চিত্র কয়েকজন মেধাবী, সুদর্শন, গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী পেলেও তাঁরা আর লিজেন্ড হয়ে উঠতে পারেননি। সৃষ্টি করতে পারেননি স্বতন্ত্র তারকা ইমেজ, স্টাইল বা স্টারডম। দু-চারজন তারকাখ্যাতি পেলেও অন্যরা চাহিদা তৈরি করতে পারেননি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সময়কে বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ বলেন বোদ্ধারা। সেই সময় চলচ্চিত্রকে স্বমহিমায় আলোকিত করেছেন রাজ্জাক-কবরী, উজ্জল-ববিতা, শাবানা-আলমগীর, ফারুক-ববিতা, বুলবুল আহমেদ-ববিতা, সোহেল রানা-সুচরিতা, জসিম-রোজিনা, ওয়াসীম-অলিভিয়া বা অঞ্জু ঘোষ, জাফর ইকবাল-ববিতা, আজিম-সুজাতা, রহমান-শবনম, আনোয়ার হোসেন-আনোয়ারা, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, সালমান শাহ-শাবনূর বা মৌসুমী, নাঈম-শাবনাজ, শাকিব খান-অপু, পপি-মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌসের মতো জুটি ও তারকা। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেক শিল্পী চলচ্চিত্রে এলেও তারকা হয়ে উঠতে পারেননি কেউই। মেগাস্টারখ্যাত উজ্জল বলেন, আসলে কেউ লিজেন্ড হয়ে জন্মায় না। পর্দার ইমেজ অভিনেতাকে লিজেন্ড করে দেয়। নিজেকে লিজেন্ড তৈরি করতে হয়- অতি যত্নে, পরিশ্রমে, সাধনায়। এখন অভিনয়শিল্পী হতে গুণ লাগছে না, সময় লাগছে না। লাগছে না কোনো পরিশ্রমও। তাই যত দ্রুত উন্নতি, তত দ্রুত পতনও হচ্ছে। এখন বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে বাণিজ্য ছাড়া কিছুই বোঝেন না। চলচ্চিত্র সম্পর্কে সম্যক লেখাপড়া ও জ্ঞানের অভাব ভালো চলচ্চিত্র তৈরি না হওয়ার অন্যতম কারণ। এ জন্য তারকা শিল্পীও তৈরি হচ্ছে না। এর জন্য মূলত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই অনেকটা দায়ী। বাংলাদেশে এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠেনি। প্রশিক্ষণের জন্য ফিল্ম ইনস্টিটিউট কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সিনিয়র চলচ্চিত্রকারদের কথায়- বিশ্বে বাংলাদেশের শাবানাই একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি একটি দেশের চলচ্চিত্র জগতে সর্বকালের সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা নিয়ে চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে গিনেস বুক অব রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন। শাবানার কান্নায় কাঁদেননি এমন নারী দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশে। কবরীর ভুবনমোহিনী হাসি মুগ্ধ করেছে সব শ্রেণির দর্শককে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার জন্য তাঁর এক ভক্ত বুকেপিঠে নাম লিখে ১৯৮৩ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন করেছিলেন। ববিতা ছিলেন সে সময়ের ফ্যাশন আইকন। অঞ্জু ঘোষ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র নায়িকা তিনি। সুচরিতা শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় শুরু করলেও পরবর্তীতে নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, একসময় তারকা শিল্পীর অভাব ছিল না। এফডিসি অনেক তারকার পদচারণায় মুখর থাকত। ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ঢাকার ছবির রমরমা অবস্থা ছিল। কবরী, শাবানা, অলিভিয়া, অঞ্জু, রোজিনা, সুচরিতা- এরা আধুনিক ছিলেন তাঁদের সময়ের থেকে। দিতি তাঁর সময়কে অতিক্রম করা প্রতিভা। রাজ্জাক ছিলেন পাশের বাড়ির ছেলে। বুলবুল আহমেদ ‘মহানায়ক’ হয়ে যে অভিনয় ক্ষমতা দেখান সেখানে আর কাউকেই তাঁর সমতুল্য লাগে না। জসিম যেভাবে রক্তচোখে তাকায়, বড় হাতের মুষ্টিতে ঘুষি মারে- ওটা আর কাউকে মানায় না। ওয়াসিমের তারুণ্য আর কারও মতো নয়। উজ্জলের একটা চিরসবুজ লুক ছিল। মেগাস্টার ইমেজ ছিল।

চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমানের বক্তব্য ছিল এমন- ‘এখন যারা অভিনয়ে আসছে তাদের মধ্যে কাজ নয়, সহজেই অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার প্রবণতা বেশি। মানে পেশার প্রতি ডেডিকেশন বলতে গেলে থাকে না বলেই বর্তমানে অভিনয়ে আসা শিল্পীরা আর তারকা হয়ে উঠতে পারে না।’
ফারুক গ্রামীণ আবহতে অনন্য। জাফর ইকবালের ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা স্টাইল, ফ্যাশন, ক্রেজ ও অভিনয়। ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয়, বডি ল্যাংগুয়েজে ফুটে ওঠে তিনি রাজত্ব করেছিলেন তাঁর সময়ে। মান্নার আওয়াজে হলের পর্দা কাঁপত। মার্শাল আর্ট দেখলে রুবেলকে বাকিদের থেকে আলাদা করা যায়। সালমান শাহ একাই একশ। অভিনয়, স্টাইল, তারকাখ্যাতি, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে অনন্তকালের একটা তৃষ্ণা তিনি। হুমায়ুন ফরীদি পর্দা আর চরিত্র শাসন করা বিরল অভিনেতা। রাজীব রাজীবই। অনেকে বলে বাঘের মতো গর্জন তাঁর। আবার কোমল অভিনয়েও মিশে যেতে পারতেন অনায়াসে। এ টি এম শামসুজ্জামানকে চিনতে একসঙ্গে তিনটি  বৈশিষ্ট্যকে মাথায় আনতে হয়। খলনায়ক, ভালো মানুষ আর কৌতুক অভিনেতা। এখন সেরকম অভিনেতা-অভিনেত্রী এখন আর গড়ে উঠছে না। অভিনেত্রী ববিতা বলেন, লিজেন্ডারি অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে গেলে সাধনার দরকার।  নতুন যাঁরা আসছেন তাঁদের মধ্যে অল্প পরিশ্রমে দ্রুত তারকা এবং অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার লোভ বেশি।

সর্বশেষ খবর