শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মানবেতর জীবনযাপন করছেন যাত্রাশিল্পীরা

মোস্তফা মতিহার

মানবেতর জীবনযাপন করছেন যাত্রাশিল্পীরা

বিবেকের দরাজ গলার গান শুনে সম্বিত ফিরে পেতেন যাত্রাপালা দেখতে আসা দর্শক-শ্রোতারা। শুধু তাই নয়, যাত্রার নায়ক-নায়িকাদের গলা ফাটানো সংলাপেও নেমে আসত নীরবতা। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী সেই যাত্রার বিবেকের সুর এখন থেমে গেছে। শীতের মৌসুমে গ্রাম-গঞ্জের পাশাপাশি মফস্বল শহরেও যাত্রার জৌলুস ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে বহু আগেই যাত্রা তার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে।  মুমূর্ষু এ যাত্রাশিল্পকে রক্ষায় শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে  বেশ কয়েকটি যাত্রা উৎসবের আয়োজন করে সংস্কৃতির এই ধারাকে আবারও চলমান করেছিল শিল্পকলা একাডেমি। কিন্তু ডুবন্ত অবস্থায় ভাসার চেষ্টারত ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো এই শিল্পে নতুন করে হানা দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। শিল্পকলা একাডেমির সদিচ্ছা ও আন্তরিক সহযোগিতায় নিবন্ধনের ভিত্তিতে যাত্রাপালা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে থেমে গেছে বিবেকের সুর, বন্ধ হয়ে গেছে নায়ক-নায়িকার দরাজ কণ্ঠের সংলাপ আর নৃত্যপটিয়সীর হৃদয় হরণ করা নৃত্যের ঝংকার। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীরা।  জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা। অটোরিকশা চালিয়ে ও ফেরিওয়ালার জীবন বেছে নিয়েছেন জীবন সংসারের তাগিদে। যে শিল্পী আনন্দ ফেরি করে মানুষকে বিনোদিত করতেন সেই শিল্পীই এখন জীবন ও জীবিকার তাগিদে ফেরিওয়ালা সেজে পথে নেমে এসেছেন। জীবনের চাকা কোনোমতে সচল থাকলেও দুঃখ ফেরি করে হাঁফিয়ে উঠেছেন অনেকে। মেকআপে আচ্ছাদিত রঙিন মানুষগুলোর জীবনের রং এখন বড়ই ফিকে ও ধূসর। হয়তো করোনা একসময় থেমে যাবে। নাটক, চলচ্চিত্র ও সংগীতসহ সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোও নতুন করে এগিয়ে যাবে। কিন্তু আবহমান বাংলার জনপ্রিয় লোকসংস্কৃতি যাত্রাপালা তার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। গত দেড় বছরের করোনায় ধুঁকতে থাকা এ শিল্প একেবারেই বন্ধের দ্বারপ্রান্তে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের খবর আর কেউ রাখে না।

দীর্ঘ ৩০ বছর যাত্রাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত এবং জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী মুক্তি রানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা শেষ। আমাদের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। খুব করুণ অবস্থায় আছি। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা না পারছি ভিক্ষা করতে, না পারছি রাস্তায় দাঁড়াতে, না পারছি কারও কাছে বলতে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কারও কাছে ফোন করলে তারা রিসিভও করছে না। খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আছি। দেড় বছর আগে শিল্পকলা একাডেমি থেকে ৫ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছিলাম, এরপর কেউ কোনো খবরও নেয়নি। সরকারের কাছে একটু ডালভাতের নিশ্চয়তা চাই, আর কিছু নয়। ১৯৭৪ সাল থেকে যাত্রাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, এখন কোনোরকমে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কেটে যাচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমি থেকে গত বছর ৫ হাজার এবং আরেকবার ১ হাজার টাকা দিয়েছিল। এ ছাড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট থেকে কিছু চাল-ডাল দিয়েছিল। তা দিয়ে কোনোরকমে চলেছি। এখন তো অবস্থা গুরুতর। গত দুই মাস ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। দেখার কেউ নেই। শিল্পীদের অবস্থা এখন এমন হয়ে গেছে যে, সামনে আসছে যখন, না পারতে কিছু একটা দিই। অথচ শিল্পীরাই জীবনবাজি রেখে নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যায়, লড়ে যায়। শেষ জীবনে শূন্য হাতে চলে যায়। ৫৫ বছর যাবৎ যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত যাত্রাশিল্পী ও বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েক বছর ধরে যাত্রাশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। করোনা শুরুর পর থেকে এটির অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আগে থেকেই বিপর্যস্ত এ শিল্পকে এখন একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে করোনা। নাটক ও চলচ্চিত্রসহ সব মাধ্যমেরই ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু বিকল্প হিসেবে তাঁরা ফেসবুক, অনলাইনে লাইভ করছেন। অনেকে শুটিং করছেন। কিন্তু যাত্রাশিল্পীদের সেই সুযোগ নেই। কীভাবে হাজার হাজার যাত্রাশিল্পী চলছেন সে খবর কেউ রাখে না। আমরা শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাব। তিনি আরও বলেন, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা তাঁর দিকে চেয়ে আছি।

বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন সোসাইটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নটরাজ এন এ পলাশ বলেন, যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান এই মহামারীর তান্ডবলীলায় যাত্রাশিল্পীরা না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। যেভাবেই হোক শুধু সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। দেশের বিভিন্ন শিল্পপতি ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্ণধারদের এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বাঙালি জাতির নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার এই যাত্রাশিল্প হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি।

সর্বশেষ খবর