শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
নাচের জগতে করোনার থাবা

মানবেতর জীবন নৃত্যশিল্পীদের

মোস্তফা মতিহার

মানবেতর জীবন নৃত্যশিল্পীদের

নাচের ছন্দময় মুদ্রার তালে তালে দুলতেন শিল্পীরা। দোলাতেন নৃত্যানুরাগীদের। তাক ধিনা ধিন তালে তালে নৃত্যের শৈল্পিকতার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত গোটা মিলনায়তনে। গানের সঙ্গে নৃত্যের মিশেল, সেই সঙ্গে ঘুঙুরের ঝনঝনানি। সুরের তালে তালে নাচে দর্শকরা শুধু মুগ্ধই হতেন না, কেঁপে উঠত আলোকিত মিলনায়তন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সবকিছু এখন সোনালি অতীত। নৃত্যের তালে তালে মঞ্চ কাঁপিয়ে মিলনায়তনজুড়ে আনন্দের ঝিলিক তৈরি করা শিল্পীদের জীবনের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে শিল্পীরা যখন নতুন করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোর মতো নাচেরও জগৎকেও ধাক্কা দেয়। নাচের চর্চা ও অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজের অভাবে মানবেতর হয়ে পড়ে এই অঙ্গনের শিল্পীদের যাপিত জীবন। মানুষের জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা শিল্পীদের জীবনটাই কাজের অভাবে এখন নিরানন্দে ভরা। এই শিল্পে জড়িতদের এখন চলছে চরম দুর্দিন। সিনিয়র থেকে শুরু করে জুনিয়র নৃত্যশিল্পী, তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢোল এবং বংশীবাদকদেরও বেকার করে দিয়েছে এই করোনা। দেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মঞ্চের নানা আয়োজন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ কেবলই বাড়ছে। নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ দীর্ঘদিনের চর্চিত পেশাকে বিদায় জানিয়ে অন্য পেশার প্রতি মনোনিবেশ করার মনস্থির করেছেন বলে জানা গেছে।

নৃত্যশিল্পী সংস্থার তথ্য মতে, দেশে ১০ হাজারের বেশি নাচের সংগঠন রয়েছে। আর ২২৫টির বেশি নাচের স্কুলে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী নৃত্যচর্চায় জড়িত রয়েছে। করোনার হানায় এদের সবার জীবনেই দুর্দশা নেমে এসেছে।

নাচের দল নৃত্যাঞ্চলের অন্যতম পরিচালক নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে শাস্ত্রীয় ও সুস্থ ধারার নাচের পৃষ্ঠপোষকতা এমনিতেই কমছে। তার ওপর করোনাভাইরাস এসে নৃত্যশিল্পীদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। আমার নিজের সংগঠন নৃত্যাঞ্চলের প্রায় শতাধিক নৃত্যশিল্পী বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ অসুস্থ মা-বাবার ওষুধ পর্যন্ত কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। এরা সরকার থেকেও কোনো প্রণোদনা পাননি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আর নীপা তাঁদের সহযোগিতা দিয়েছি। এটা দিয়ে কতদিন চলবে। আমরা সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি আশা করছি।

নৃত্যশিল্পী ডলি ইকবাল বলেন, খুব ব্যয়বহুল একটা মাধ্যম হওয়ার পরও নাচ খুবই অবহেলিত। করোনার কারণে দেশে নাচের আয়োজন বন্ধ থাকলেও ২৬ থেকে ২৭টি চ্যানেলে নাটক ঠিকই প্রচার হচ্ছে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কী ঈদের কোনো আয়োজনে নাচ রাখতে পারত না? অন্তত ২০টি চ্যানেলে যদি ২০টি নাচের আয়োজন রাখা হতো তাহলে কম করে হলেও ২০ জন নৃত্যশিল্পী কিছু উপার্জন করতে পারতেন। বুঝতে পারছি না কেন আমরা এত অবহেলিত।

নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক বলেন, নৃত্যশিল্পীদের এখন চরম দুর্দিন চলছে। অথচ করোনা মহামারী শুরুর আগেও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানের। কিন্তু করোনা সব ভেস্তে দিল। সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের ৩০ জেলায় আমরা ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছি।

নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। আমি নিজে অনেক ব্যস্ত থাকতাম। আর এখন আমি নিজেই বেকার হয়ে গেছি। আমার নাচের স্কুল ও প্রোগ্রামসহ সবই বন্ধ। সোর্স অব ইনকাম বলতে যা বোঝায় আমার জায়গা থেকে তা করতে পারছি না। সে জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শুধু নাচের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে। শুধু শিল্পীরাই নয়, যারা নাচের ড্রেস বানায়, ফুলের অর্নামেন্ট বানায়, ঘুঙুর বানায় তারাও বেকার হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে ওরাও জড়িত।

নৃত্যশিল্পী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সাকিব বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে পাস করে বেছে নিয়েছি নাচকে। প্রায় ২০ বছর চলছে আমার নৃত্যচর্চা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রোগ্রামেও অংশ নিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের জীবন বড়ই সংকটময়। সীমাহীন কষ্টে আছি। তারপরও লজ্জায় কারও কাছে কিছু চাইতে পারি না। আমি তো শিল্পী, বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু মুখ ফুটে চাইতে পারি না। আত্মসম্মানে লাগে। সরকার যদি একটু নজর দিত, তাহলে আমরা রেহাই পেতাম। প্রতিশ্রুতিশীল নৃত্যশিল্পী প্রিয়াংকা রানী দেবনাথ বলেন, ভালো লাগা ও ভালোবাসার কারণেই নাচের সঙ্গে পথ চলছি সেই ছোটবেলা থেকে। দেশের বাইরেও নাচের প্রোগ্রাম করেছি। সুন্দর জীবন ছিল আমাদের। কিন্তু করোনার থাবায় আমাদের জীবন এখন হতাশাগ্রস্ত। সরকার যদি এগিয়ে না আসে তাহলে সংস্কৃতির এই মাধ্যমটি টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে।

সর্বশেষ খবর