মঙ্গলবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্র আমদানির এপিঠ-ওপিঠ

চলচ্চিত্র আমদানির এপিঠ-ওপিঠ

সিনেমা হল নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য ঋণ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সিনেমা হল মালিকদের উদ্বেগ হলো ঋণ নিয়ে এই অর্থ কীভাবে শোধ করা হবে। কারণ দেশে পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত ছবির অভাব রয়েছে। এ অভাব পূরণে প্রদর্শকরা চান ভারতীয় ছবি আমদানি করতে। এ বিষয়ে চলচ্চিত্রকারদের মত তুলে ধরেছেন -আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এটি নিরেট বাস্তবতা : কাজী হায়াৎ

ছবি আমদানির বিষয়টিকে আমি নিরেট বাস্তবতা হিসেবে দেখছি। কারণ সিনেমা হল বাঁচাতে ছবি প্রয়োজন। আর সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি দরকার। তাই প্রদর্শকদের ভারতীয় ছবি আমদানির দাবি যৌক্তিক। আমাদের দেশে যখন প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তার আগেও কিন্তু এখানে সিনেমার ব্যবসা ছিল। বিদেশি ছবি বিশেষ করে কলকাতা, বোম্বে, লাহোরের ছবি এখানে প্রদর্শিত হতো। এখন যেহেতু ছবির পরিমাণ কম, তাই বিদেশি ছবি আমদানি করা যেতেই পারে। সরকার সিনেমা নির্মাণে অনুদান দিচ্ছে। এই অনুদানের টাকা বরাবরই পেয়ে আসছে আর্টফিল্ম টাইপের ছবিগুলো। এই অনুদানের অর্থের একটি অংশ যদি বাণিজ্যিক বা মূলধারার ছবি নির্মাণে দেওয়া হতো তাহলে নির্মাতারা বেশি পরিমাণে মানসম্মত ছবি নির্মাণে উৎসাহিত হতো এবং প্রদর্শকদের তখন আর বিদেশি ছবি আমদানির চিন্তা করতে হতো না এবং সিনেমা হল বেঁচে যেত। সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নে যে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ঠিক একইভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যও ঋণ দেওয়া জরুরি। তা না হলে সিনেমা হল বাঁচাতে সিনেমা আমদানি করতে দিতে হবে।

 

আমদানির বিকল্প নেই : সুদীপ্ত কুমার দাস

ভারতীয় ছবি আমদানির ওপর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রণীত প্রথম আমদানি নীতিতে (১৯৭৩) উপমহাদেশীয় ভাষার ছবি আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত আমদানি নীতি আদেশে এটি প্রত্যাহার করা হলে সিনেমা হল মালিকরা একে স্বাগত জানান। কিন্তু প্রযোজক, পরিবেশক, শিল্পী, কলা-কুশলী সবাই এর বিরোধিতা করেন এবং ২০১০ সালের ১৪ জুন পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২০১০ সালেও দেশে ৬-৭ শ সিনেমা হল চালু ছিল। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, তখন ভারতীয় ছবি আমদানির সুযোগ বহাল থাকলে ১১০০টি সিনেমা হল বন্ধ হতো না। চলচ্চিত্রশিল্প আজকের মতো এই বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ত না। তবুও সুখের বিষয় এই যে, প্রযোজক, পরিবেশক, পরিচালক এবং অনেক শিল্পী, কলা-কুশলী প্রকাশ্যে কিংবা একান্তে এটি স্বীকার করে নিচ্ছেন, ভারতীয় ছবি না আনলে সিনেমা হল বাঁচবে না। আর সিনেমা হল না বাঁচলে সিনেমা শিল্প ও এই ব্যবসা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সিনেমা হল মালিক বা প্রযোজকের চাইতে পরিচালক, শিল্পী ও কলা-কুশলীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির জন্য  প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি।

 

২০১০ সালেও দেশে ৬-৭ শ সিনেমা হল চালু ছিল। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, তখন ভারতীয় ছবি আমদানির সুযোগ বহাল থাকলে ১১০০টি সিনেমা হল বন্ধ হতো না। চলচ্চিত্রশিল্প আজকের মতো এই বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ত না

 

ছবি ছাড়া সিনেমা হল অচল : মোহাম্মদ হোসেন

সরকার সিনেমা হল উন্নয়নে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু এই ঋণ কীভাবে গ্রহণ, ফেরত ও কাজে লাগানো যায় তা সিনেমা হল মালিকদের বোঝাতে প্রদর্শক সমিতি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিনেমা হল ছাড়া ছবি আর ছবি ছাড়া সিনেমা হল চলবে না। তাই যদি দেশে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাব থাকে অবশ্যই সেই অভাব পূরণে ভারতীয় ছবি আমদানি করতে হবে। সরকার প্রতি বছর চলচ্চিত্র নির্মাণে যে অনুদান দিচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে না। শুধু আর্টফিল্মকে কেন? কমার্শিয়াল ছবি নির্মাণেও অনুদান দিতে হবে। পুরনো প্রযোজক, পরিচালকদের ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য প্রযোজক, পরিচালক, প্রদর্শক ও শিল্পী সমিতির সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তাহলে আর ভারতীয় ছবি আমদানির প্রয়োজন হবে না। না হলে সিনেমা হল বাঁচাতে ভারতীয় ছবি আমদানির কোনো বিকল্প থাকবে না।

 

সময় নিতে হবে : মিশা সওদাগর

যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি নেই তাই ভারতীয় ছবি আমদানির বিকল্প নেই। সরকার সিনেমা হল তৈরির জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এটি শুভ উদ্যোগ। আধুনিক ও পর্যাপ্ত সিনেমা হল তৈরি হলে সিনেমা হল বাড়াতে প্রযোজকদের মধ্যে অর্থ ফেরত পাওয়ার আস্থা তৈরি হবে এবং তাঁরা উৎসাহিত হয়ে আবার ব্যাপক হারে নির্মাণে ফিরে আসবেন। এই বিষয়টির প্রতি সিনেমা হল মালিকদের প্রথমেই লক্ষ্য রাখতে হবে। এরপরও যদি পর্যাপ্ত ও মানসম্মত স্থানীয় কনটেন্ট পাওয়া না যায় তাহলে অবশ্যই আমদানির চিন্তা করতে হবে। সিনেমা হল মালিকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা সিনেমা হলের উন্নয়ন করে কমপক্ষে দুই বছর অপেক্ষা করুন, তারপরও যদি দেশি কনটেন্টের অভাব থাকে তাহলে আমদানির চিন্তা করুন। প্রধানমন্ত্রী, দেশীয় চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আগে দেশি ছবি উৎপাদন করতে হবে। সিনেমা হল মালিকদের প্রতি আর একটি অনুরোধ, আপনারা আগের মতো ছবি প্রযোজনা করুন। একই সঙ্গে সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে সিনেমা নির্মাণেও ঋণ দেওয়া হোক। তারপরও যদি ছবির সংকট থাকে তাহলে আমি শিল্পীদের নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানিতে প্রদর্শকদের পূর্ণ সহায়তা দিয়ে যাব।

 

আমদানি করলে প্রতিযোগিতা বাড়বে : খোরশেদ আলম খসরু

প্রায় ৪৫ বছর ধরে উপমহাদেশীয় ছবিকে প্রোটেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়ে আবার বাতিল করেছে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা আমাদের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। এটা হওয়া খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে বলা হয়, বিদেশি ছবি আমদানি করলে স্থানীয় পরিচালক, শিল্পী, কলা-কুশলীরা বেকার হয়ে পড়বে। এটি ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভালো ছবি নির্মাণ শুরু হলে কাজের ক্ষেত্র আরও বাড়বে। এখন একটি ছবিকে নানা আঙ্গিকে প্রমোট করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ছবি ওটিটি, ইউটিউব, টিভি, রিংটোন ইত্যাদিতে দেওয়ার রাইট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এসব রাইট ব্যাংকে মর্ডগেজ রেখে ছবি নির্মাণে ঋণ দিলে ছবির অভাব পূর্ণ হবে। আমি মনে করি সিনেমা হল উন্নয়নের মতো সিনেমা নির্মাণেও যদি সরকার ঋণ দেয় তাহলে দেশীয় চলচ্চিত্র আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

সর্বশেষ খবর