রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলা সিনেমায় পোস্টারের বিবর্তন...

বাংলা সিনেমায় পোস্টারের বিবর্তন...

সিনেমা যেমন শিল্প, সিনেমার পোস্টারও একরকম শিল্প। সিনেমা এবং শিল্পের দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাসের সাক্ষী এই পোস্টার। যুগে যুগে সিনেমা যেমন বদলেছে, বদলেছে সিনেমার পোস্টারও। পোস্টারের পালাবদলের খবর জানাচ্ছেন- পান্থ আফজাল 

সিনেমার পোস্টার বললেই ঢাউস, বড়সড়, রংচঙে পোস্টারগুলোর কথা মনে আসে, তাই না? কিন্তু এক সময় সেগুলোর মধ্যেও সুন্দর একটা শিল্পসত্তা উঁকিঝুঁকি মারত। কারণ একটাই; সেই পোস্টারগুলো বেশ যত্ন করে হাতে আঁকা হতো। এখনকার ডিজিটাল পোস্টারগুলোতে কিন্তু সেই গুণ নেই।

সিনেমাতে প্রচারণার অন্যতম পন্থা পোস্টার। তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, সেই শৈল্পিক ও নান্দনিক হাতে আঁকা পোস্টার আর নেই; পোস্টারে নেই দর্শককে আকর্ষণ করার মতো তেমন নান্দনিকতা। কেবল পোস্টার ও বুকলেটই নয়, আগে সিনেমার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো পত্রিকাতেও। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের চলটা ছিল এই কিছু দিন আগেও। অশ্লীলতার যুগে আস্তে আস্তে চলটা হারিয়ে যায়। মাঝে কিছু বিগ বাজেট ছবির বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখা যেত। পত্রিকায় ছাপা এই বিজ্ঞাপনগুলোর কয়েকটি ভীষণ ব্যতিক্রমী, চোখ আটকে রাখার মতো। তবে উল্লেখ করার মতো নয়।

বাংলা চলচ্চিত্রে পোস্টার দিয়ে প্রচারণা শুরু হয় ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭-এর দিকে। দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র আবদুল জব্বার খানের ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। যদিও এর আগে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মিত হয় এদেশে। কিন্তু সে সময়ের কোনো ছবির পোস্টার পাওয়া যায়নি। এফডিসির সহায়তায় নির্মিত দ্বিতীয় মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হচ্ছে মহিউদ্দিনের ‘মাটির পাহাড়’। এটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলে এফডিসির সহায়তায় প্রথম ফতেহ লোহানীর ‘আসিয়া’ সিনেমা নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু এটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। সেই বছরই মুক্তি পায় এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’। যেটিতে অভিনয় করেছেন রহমান, সুমিতাসহ অনেকেই। এরপর একে একে মুক্তি পায় ‘যে নদী মরুপথে’, ‘জোয়ার এলো’, ‘চান্দা’, ‘ধারাপাত’, ‘তালাশ’, ‘সুতরাং’, ‘রূপবান’, ‘মালা’, ‘১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘সান অব পাকিস্তান’, ‘বেহুলা’, ‘আপন দুলাল’, ‘কার বউ’, ‘আলিবাবা’, ‘আনোয়ারা’, ‘চকোরী’, ‘ছোট সাহেব’, ‘দরশন’, ‘নয়নতারা’, ‘সাইফুল মুলক বদিউজ্জামান’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘আবির্ভাব’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘হারানো দিন’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘কখগঘঙ’, কাঁচের স্বর্গ, ‘নাচের পুতুল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘সমাধান’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘কত যে মিনতি’, ‘আগন্তুক’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘মানুষের মন’, ‘অন্তরঙ্গ’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘যাহা বলিব সত্য’, ‘জীবন থেকে নেয়া’সহ অনেক দর্শকপ্রিয় সিনেমা। ঢাকাই ছবির যাত্রালগ্ন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত অসংখ্য দর্শকপ্রিয় সিনেমা নির্মিত হয়। সব ধরনের দর্শককে এক জাদুতে সিনেমা হলে ধরে রাখার মতো গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতারও অভাব ছিল না। সিনেমা হল থেকে শুরু করে সর্বত্রই দেখা যেত নায়ক-নায়িকা সাঁটা শৈল্পিক সব হাতে আঁকা পোস্টার। পোস্টার-ব্যানার আঁকা হতো বাঁশের চটায়।  পোস্টারে দেখা যেত চড়া রঙ, নাটকীয়তা এবং বাস্তবধর্মিতা। শিল্পীদের অঙ্কনশৈলীতে বাস্তব ছোঁয়া পেত ছবির পোস্টারগুলো। তবে সংরক্ষণের অভাবে যেখানে আমাদের পুরনো অনেক চলচ্চিত্রই হারিয়ে গেছে, সেখানে অধিকাংশ পুরনো পোস্টারই যে নতুন প্রজন্মের দেখার সৌভাগ্য হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তারপরও যে পোস্টারগুলো পাওয়া যায়, তার মধ্যে এমন কিছু পোস্টারও আছে, যেগুলোর দুর্দান্ত ডিজাইন ও অনন্য ভাবনা বিশেষভাবেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে সেসব নান্দনিক আর্ট মরতে বসেছে। বলা যায়, মরেই গেছে।

পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশ এবং ষাট দশকে এখানকার চলচ্চিত্রের পোস্টার কিছু হতো লিথো পদ্ধতিতে। আবার প্রযুক্তিগত সুবিধার জন্য কিছু পোস্টার ইউরোপ থেকে ছাপিয়ে আনা হতো। এ পর্যায়ে কাইয়ুম চৌধুরীর অলঙ্কৃত, নায়ক রহমান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ও ‘ইন্ধন’-এর পোস্টার দুটির নাম করা যেতে পারে। আবদুল সবরের আঁকা পরিচালক খান আতাউর রহমানের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ও ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’র নান্দনিক পোস্টার দুটোও এক্ষেত্রে স্মরণীয়। এ ছাড়া শিল্পী নিতুন কুন্ডু একটি ব্যতিক্রমী পোস্টার আঁকেন ‘তানহা’ ছবির জন্য। পোস্টার শিল্পী হিসেবে সুভাষ দত্ত এবং এ জেড পাশাও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পোস্টারটিও করেন সুভাষ দত্ত। পাকিস্তান পর্বে সিনেমার পোস্টার ডিজাইনের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠান ‘কামার্ট’ ও ‘এভারসিন পাবলিসিটিং’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর ব্যাপকভাবে এদেশেই সিনেমার পোস্টার ছাপা হতে থাকে। তবে তখন এই পোস্টারগুলো হতো এক রঙের। পরে সত্তর দশকের শেষার্ধে প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ছাপারও উন্নয়ন ঘটে। গ্রাফিক্স ডিজাইনের নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়। সত্তর দশকের শেষ দিকে রঙিন পোস্টার ছাপা হতে থাকে। সর্বশেষ ডিজিটাল প্রযুক্তি। আশির দশক থেকে ২০০০ সালের মধ্যে অসংখ্য ভালো ছবি দর্শক দেখেছে। সালমান শাহের সময় তো ভিউকার্ড দেদার বিক্রি হতো। সেখানে শোভা পেত সিনেমার ছোট ছোট মুহুর্ত। ওমর সানী, মৌসুমী, শাবনূর, শাবনাজ, নাঈম, মান্না, পপি, রিয়াজ, ফেরদৌস, পূর্ণিমা, শাকিল খান, শাকিব খান থেকে শুরু করে অনেক তারকার পোস্টার-ব্যানার শোভা পেত হলে। এ সময়ের অনেক নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল পোস্টার। তবে সেই সময়কে টেক্কা দিতে পারছে কি? প্রতি বছর প্রচুর সিনেমা মুক্তি পেলেও বেশির ভাগ ছবির পোস্টারে পাওয়া যায় না নান্দনিকতার ছোঁয়া।  তবু কিছু সিনেমার পোস্টার করে পরিচিতি পেয়েছেন সাজ্জাদুল ইসলাম সায়েম, অর্ণিল হাসান রাব্বিরা।  তারা মনে করেন, ভালো পোস্টার ডিজাইন করতে গল্প জেনে, নায়ক-নায়িকার চরিত্র বুঝে করলে অবশ্যই দর্শক আকৃষ্ট হবেন।

সর্বশেষ খবর