রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তবে কি বিদেশি ছবিই ভরসা?

সিনেমা হল উন্নয়নে ঋণ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সিনেমা হল মালিকদের উদ্বেগ ঋণ নিয়ে কীভাবে শোধ করা হবে। কারণ দেশে পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত ছবি নেই। ছবির এ অভাব পূরণে প্রদর্শকরা চান ভারতীয় ছবি আমদানি করতে। এ নিয়ে চলচ্চিত্রকারদের মতামত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

তবে কি বিদেশি ছবিই ভরসা?

ছবি আমদানি করতেই হবে

------------ ইফতেখার নওশাদ

আমাদের যেহেতু দেশীয় ছবি নেই এবং উপমহাদেশীয় ছবিও আমদানি করা যাচ্ছে না, তাই হলিউডের জনপ্রিয় ছবি সিনেমা হলে একসঙ্গে মুক্তি দিতে হবে। ১৯৭৬ সালে আমাদের মধুমিতা মুভিজের মাধ্যমে হলিউডের ছবি আমদানি করে এ দেশের সিনেমা হলে প্রদর্শন শুরু করি এবং তা ব্যাপক দর্শক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। মধুমিতা সিনেমা হলে ‘টাইটানিক’ ছবিটি একটানা ২৮ সপ্তাহ প্রদর্শিত হয়। এখন আবার হলিউডের ছবি নিয়মিত আমদানি করতে যাচ্ছি এবং ছবিটি একই দিনে এ দেশেও মুক্তির ব্যবস্থা করছি। নব্বই দশকে পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে বলতে গেলে সব সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে তারা সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রদর্শন করা শুরু করে। এতে সিনেমা হলে দর্শক ফিরতে শুরু করে এবং সিনেমা হলের ব্যবসা চাঙা হয়ে ওঠে। বন্ধ সিনেমা হল খুলতে শুরু করে এবং নতুন সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয়। সিনেমা হল বেড়ে যাওয়ায় প্রযোজকরা লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আসার নিশ্চয়তা পেয়ে ভারতীয় ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিয়ে উন্নতমানের ছবি নির্মাণ শুরু করেন। এতে পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প এখন বলতে গেলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের সিনেমা শিল্পকেও আবার জাগিয়ে তুলতে বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় ছবি আমদানির কোনো বিকল্প নেই।

 

ছবি আমদানি যৌক্তিক

-----------কাজী হায়াৎ

ছবি আমদানির বিষয়টিকে আমি নিরেট বাস্তবতা হিসেবে দেখছি। কারণ সিনেমা হল বাঁচাতে ছবি প্রয়োজন। আর সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি দরকার। তাই প্রদর্শকদের ভারতীয় ছবি আমদানির দাবি যৌক্তিক। আমাদের দেশে যখন প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় তার আগেও কিন্তু এখানে সিনেমার ব্যবসা ছিল। বিদেশি ছবি বিশেষ করে কলকাতা, বোম্বে, লাহোরের ছবি এখানে প্রদর্শিত হতো। এখন যেহেতু ছবির পরিমাণ কম, তাই বিদেশি ছবি আমদানি করা যেতেই পারে। সরকার সিনেমা নির্মাণে অনুদান দিচ্ছে। এই অনুদানের টাকা বরাবরই পেয়ে আসছে আর্টফিল্ম টাইপের ছবিগুলো। এই অনুদানের অর্থের একটি অংশ যদি বাণিজ্যিক বা মূলধারার ছবি নির্মাণে দেওয়া হতো তাহলে নির্মাতারা বেশি পরিমাণে মানসম্মত ছবি নির্মাণে উৎসাহিত হতো এবং প্রদর্শকদের তখন আর বিদেশি ছবি আমদানির চিন্তা করতে হতো না। সিনেমা হল বেঁচে যেত। সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নে যে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ঠিক একইভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যও ঋণ দেওয়া জরুরি। তা না হলে সিনেমা হল বাঁচাতে সিনেমা আমদানি করতে দিতে হবে।

 

বিদেশি ছবিই ভরসা

----------সুদীপ্ত কুমার দাস

স্থানীয়ভাবে ছবি নির্মাণ কমেছে। চলচ্চিত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে নানা শর্ত আরোপে স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। নতুন নীতিমালার অসংগতির কারণে যৌথ প্রযোজনাও বন্ধ রয়েছে। ভারতীয় ছবি না আনলে সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যাবে না এবং সরকার সিনেমা হলের উন্নয়ন ও সংস্কারে যে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে ছবি না থাকলে সিনেমা হল মালিকরা সেই ঋণ নিয়ে ফেরত দেবে কীভাবে? ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার উপমহাদেশীয় ছবি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। মূলত সে সময়ের শিশু চলচ্চিত্র শিল্পকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্যই ছিল এই নিষেধাজ্ঞা। তখন সরকার শুধু চলচ্চিত্রই নয়, শিল্প এবং বাণিজ্যের বহু ক্ষেত্রেই প্রোটেকশন নীতি জারি করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আদলে। তখন সমস্ত শিল্পই জাতীয়করণকৃত ছিল। পরবর্তীতে জাতীয়করণকৃত শিল্পগুলো ধীরে ধীরে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হলো। আর এখন তো উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির জোয়ারে তৎকালীন সরকারের সমস্ত পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থায় দেশ চলছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও ১৯৭৭-৭৮ সালে চলচ্চিত্রকে সরকারি আয়ের একটি ক্ষেত্র ধরে নিয়ে সিনেমার টিকিটের আবগারি শুল্কের হার দেড় শ পার্সেন্ট করা হলো। যা পৃথিবীর কোনো দেশেই ছিল না। আবার ভারতীয় ছবি আমদানি নিষিদ্ধ রেখে ভিসিআরে ভারতীয় ছবির প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হলো। ১৯৯২ সালে আকাশ সংস্কৃতি মুক্ত করে দেওয়া হলো। এতে কোনো রকম নিয়মনীতি জারি না করেই বিদেশি টিভি চ্যানেলে অবাধে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন শুরু হয়।  এর ফলে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণি ঘরে বসে সেন্সরবিহীন অবস্থায় ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখার সুযোগ পেল। অথচ আমদানি আর সেন্সর করে সিনেমা হলে দর্শকদের ওই ছবিগুলো দেখার সুযোগ দেওয়া হলো না। এখন ইউটিউবসহ নেটের মাধ্যমে মোবাইল সেটেও বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ হয়ে গেছে। পাশাপাশি হলিউডের ছবি ঢাকায় একই দিনে মুক্তির সুযোগ করে দেওয়া হলো।  এমতাবস্থায় প্রশ্ন তুলছি ভারতীয় ছবি আনলেই নাকি দেশের কৃষ্টি-কালচার ধ্বংস হয়ে যাবে। তাহলে ইংরেজি ছবি কোন সংস্কৃতিকে লালন করে? প্রোটেকশনের ফলে অন্ধভাবে ভারতীয় ছবির নকল করে এদেশে ছবি নির্মিত হয়। এটি কোন সংস্কৃতির ধারক? এখনো যদি উপমহাদেশীয় ছবির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় তাহলে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক আসবে এবং সিনেমা হল মালিকরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে সিনেমা হলের সংস্কার ও আধুনিকায়ন করবে। ২০১০ সালেও দেশে ছয়-সাত শ সিনেমা হল চালু ছিল। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তখন ভারতীয় ছবি আমদানির সুযোগ বহাল থাকলে ১১০০টি সিনেমা হল বন্ধ হতো না। চলচ্চিত্রশিল্প আজকের মতো এই বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ত না। মানে বিদেশি তথা ভারতীয় ছবিই এখন একমাত্র ভরসা।

 

ছবি আমদানি দরকার

---------- মিশা সওদাগর

যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি নেই তাই ভারতীয় ছবি আমদানির বিকল্প নেই। সরকার সিনেমা হল তৈরির জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এটি শুভ উদ্যোগ। আধুনিক ও পর্যাপ্ত সিনেমা হল তৈরি হলে সিনেমা হল বাড়াতে প্রযোজকদের মধ্যে অর্থ ফেরত পাওয়ার আস্থা তৈরি হবে এবং তারা উৎসাহিত হয়ে আবার ব্যাপকহারে নির্মাণে ফিরে আসবেন। এ বিষয়টির প্রতি সিনেমা হল মালিকদের প্রথমেই লক্ষ্য রাখতে হবে। এরপরও যদি পর্যাপ্ত ও মানসম্মত স্থানীয় কনটেন্ট পাওয়া না যায় তাহলে অবশ্যই আমদানির চিন্তা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, দেশীয় চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আগে দেশি ছবি উৎপাদন করতে হবে। সিনেমা হল মালিকদের প্রতি আর একটি অনুরোধ, আপনারা আগের মতো ছবি প্রযোজনা করুন। একই সঙ্গে সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে সিনেমা নির্মাণেও ঋণ দেওয়া হোক। তারপরও যদি ছবির সংকট থাকে তাহলে আমি শিল্পীদের নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানিতে প্রদর্শকদের পূর্ণ সহায়তা দিয়ে যাব।

 

আমদানিতে প্রতিযোগিতা বাড়বে

------------ খোরশেদ আলম খসরু

প্রায় ৪৫ বছর ধরে উপমহাদেশীয় ছবিকে প্রোটেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালে সরকার আমদানির অনুমতি দিয়ে আবার বাতিল করেছে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা আমাদের পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। এটা হওয়া খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে বলা হয়, বিদেশি ছবি আমদানি করলে স্থানীয় পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলীরা বেকার হয়ে পড়বে। এটি ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে প্রতিযোগিতায় গিয়ে ভালো ছবি নির্মাণ শুরু হলে কাজের ক্ষেত্র আরও বাড়বে। এখন একটি ছবিকে নানা আঙ্গিকে প্রমোট করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ছবি ওটিটি, ইউটিউব, টিভি, রিংটোন ইত্যাদিতে দেওয়ার রাইট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এসব রাইট ব্যাংকে মর্ডগেজ রেখে ছবি নির্মাণে ঋণ দিলে ছবির অভাব পূর্ণ হবে।  আমি মনে করি সিনেমা হল উন্নয়নের মতো সিনেমা নির্মাণেও যদি সরকার ঋণ দেয় তাহলে দেশীয় চলচ্চিত্র আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর