শুক্রবার, ৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভালো দিন যাচ্ছে না বগুড়ার নাট্যাঙ্গনের

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

ভালো দিন যাচ্ছে না বগুড়ার নাট্যাঙ্গনের

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটক পরিবেশন করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা

ভালো দিন যাচ্ছে না বগুড়ার নাট্যাঙ্গনের। যতই দিন যাচ্ছে ততই কর্মী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাসকালে নাটকসহ সব সাংস্কৃতিক কর্ম বন্ধ থাকায় নাটকের বিভিন্ন সংকট আরও দিগুণ হয়েছে।

কালে কালে মহড়া দিয়েছে অনেক। মঞ্চ সেজেছে, গড়েছে আবার ভেঙেও গেছে। মঞ্চের কারসাজি দেখে দর্শক-শ্রোতারা এ নিয়ে বিনোদন উপভোগ করলেও নাট্যকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো আজও পূরণ হয়নি। নির্মাণ হয়নি নাটকের জন্য কোনো আলাদা অডিটোরিয়াম। একদিকে সরকারি সহযোগিতা আশানুরূপ না পাওয়া, নাটকের জন্য উন্নত মঞ্চ না থাকা, অডিটোরিয়ামের ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চলছে বগুড়ার নাট্য আন্দোলন। এর সঙ্গে মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দেড় বছর থমকে আছে বগুড়ার নাট্য মঞ্চায়নসহ জেলার সাংস্কৃতিক কর্ম।

জানা যায়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বগুড়ার ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল। স্বাধীনতার আগে ভারতবর্ষের বেশ কিছু দল বগুড়ায় এসে নাটক করে গেছেন। জাতীয় কবির উপাধি পাওয়ার আগে বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন বগুড়ায়। তিনি বগুড়ায় এসে একটি সংগীত পরিবেশন করেছিলেন বলে শ্রুতি রয়েছে। দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে বগুড়ায় নাট্য আন্দোলন, নাট্যচর্চা ছিল সব সময় গতিশীল। নাটক নিয়ে জেলার কর্মীরা জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন। দেশের নাট্যজগতের প্রয়াত শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীসহ অনেকেই নাটক নিয়ে কাজ করে গেছেন বগুড়ায়। কাজ করে গেলেও থেকে গেছে মঞ্চের সমস্যা। দীর্ঘদিন যাবৎ মঞ্চের সমস্যা থেকে গেলেও কখনো সমাধান করা হয়নি। দিন দিন নাট্য সংগঠনের সংখ্যা বাড়লেও নাটকের জন্য কোনো আলাদা অডিটোরিয়াম গড়া হয়নি। বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সংগঠন রয়েছে ৭৯টি। এর বাইরেও রয়েছে বেশ কিছু ছোট-বড় সংগঠন। ছোট সংগঠনগুলোও নাটকের কাজ করে থাকে। জেলা সদরে বর্তমানে ছয়টি অডিটোরিয়াম রয়েছে। এর মধ্যে শহীদ টিটু মিলনায়তন, উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরি, মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম দুলাল অডিটোরিয়াম, শিল্পকলা একাডেমি নতুন ও পুরনো এবং জেলা পরিষদ মিলনায়তন। ছয়টির মধ্যে শিল্পকলা একাডেমি পুরনোটিতে আপাতত কোনো মঞ্চায়ন হয় না। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম দুলাল অডিটোরিয়ামের অবস্থা নাজুক। অপর চারটির মধ্যে বগুড়া পৌরসভার আওতায় শহীদ টিটু মিলনায়তন, উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তন, শিল্পকলা একাডেমি নতুন ভবন ও জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম রয়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য শহীদ টিটু মিলনায়তন সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করে ৬ হাজার টাকা করে। এরপর সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবির মুখে সে ভাড়া কমিয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। জেলা পরিষদের ৩ হাজার টাকা, উডবার্ণ পাবলিক লাইব্রেরি ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া। শহীদ টিটু মিলনায়তনকে সাংস্কৃতিক পল্লী হিসেবে বলা হয়ে থাকে। চারতলা মিলনায়তনের ছোট ঘরগুলো বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাড়া নিয়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ড করার পাশাপাশি নিয়মিত নাটক, গান, আবৃত্তি চর্চা করে থাকে। সে ঘরগুলোরও ভাড়া করা হয়েছে মাসিক প্রায় ২ হাজার টাকা। জেলা পর্যায়ে মাত্র ছয়টি অডিটোরিয়াম থাকলেও নাটকের জন্য কোনো আলাদা মঞ্চ নির্মাণ করা হয়নি। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০টি নাট্য সংগঠন কাজ করলেও নাটক মঞ্চায়নের জন্য তেমন কোনো মঞ্চ নেই। জেলার নাট্যকর্মীদের এ নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। হলগুলোতে সাউন্ড সিস্টেম ও আলো নেই, মঞ্চের অতিথি চেয়ার-টেবিল সংকট, নান্দনিকতা নেই, বিশেষ পর্দার ব্যবস্থা নেই, গরমে এসি ব্যবহারের সুযোগ নেই, বিদ্যুৎ না থাকলে থাকতে হয় অন্ধকারে- এমন সব নানা সমস্যা থাকার পরও বেশির ভাগ হলের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। নাট্যান্দোলনকে গতিশীল করতে নাট্যকর্মীরা হলের ভাড়া ও সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে কর্মী সংকট বিষয়ে নাট্যকর্মীরা বলছেন, জাতীয়ভাবে নাট্য উৎসব হয়ে থাকে। কিন্তু নাট্য প্রতিযোগিতা হয় না। প্রতিযোগিতা, ভালো নাট্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, কর্মক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারলে নাট্যকর্মী সংকট কিছুটা হলেও কমে যাবে।

বগুড়ায় ‘মহাস্থান’ নাটকের একটি দৃশ্য

বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানান, বগুড়ায় নাটক করার মতো ভালো মঞ্চ নেই। শহীদ টিটু মিলনায়তন থাকলেও সেখানে ভালো লাইটিং সাউন্ড সিস্টেম ও জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। নাটকের সংগঠনগুলো অলাভজনক। ভালো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ভালো অভিনেতা তৈরি বা নাটকে কাজ করার জন্য অর্থের প্রয়োজন হলেও আমরা জোগান দিতে পারছি না। বেশ কিছু সংগঠন নিয়মিত নাটক নিয়ে কাজ করতে পারলেও অন্য সংগঠনগুলো অর্থাভাবে কাজ করতে পারছে না। হারাতে হচ্ছে দর্শক। বগুড়ার নাট্যকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকে হলগুলোর ভাড়া কমানোর দাবির পাশাপাশি নাটকের জন্য আলাদা মঞ্চ দাবি করে আসছেন।

নাটক ‘চক্ষুদান’

বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দফতর সম্পাদক এইচ আলিম জানান, বগুড়ায় নাটকের স্থায়ী মঞ্চ নেই। একাধিক অডিটোরিয়াম থাকলেও সেখানে নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। লাইটিং নেই, শব্দ সমস্যা, টিকিট করলে হলের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। ভালো মানের নাটকের জন্য টিকিট করলে দর্শক পাওয়া যায় না। এসবের পরও নিজেদের আবহমান সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

বগুড়ার প্রবীণ নাট্যাভিনেতা জাহেদুর রহমান মুক্তা জানান, বগুড়ার নাট্যকর্মীরা জাতীয় পর্যায়ে সবসময় অবদান রেখে আসছেন। কিন্তু, শুরুতেই যদি আরও ভালো সুযোগ-সুবিধা পায় তাহলে আরও ভালো কিছু করার সুযোগ থাকে। এ কারণে বগুড়ায় অতি দ্রুত আধুনিক একটি নাটকের মঞ্চ নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। নাট্য আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে যত দ্রুত মঞ্চ নির্মাণ হবে ততই নাট্য আন্দোলনের গতি বাড়বে। ভালো নাট্যমঞ্চ নাট্যকর্মীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। এখনো তা পাওয়া হয়নি বগুড়ার নাট্যকর্মীদের। যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বগুড়া থিয়েটার জেলা পরিষদ মঞ্চে ‘চক্ষুদান’ নাটক মঞ্চস্থ করেছে। করোনায় অনুমতি না থাকায় থমকে আছে বগুড়ার নাট্যমঞ্চ।

সর্বশেষ খবর