শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মঞ্চায়নের অপেক্ষায় ৯৯টি যাত্রাপালা

মোস্তফা মতিহার

মঞ্চায়নের অপেক্ষায় ৯৯টি যাত্রাপালা

আকাশ সংস্কৃতির মাত্রাতিরিক্ত প্রভাবে অনেক আগ থেকেই বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার শেকড়ের সংস্কৃতি যাত্রাপালা। আপন দুলাল, রহিম-রূপবান, দেওয়ানা মদিনা, আলাল-দুলাল, সাগরভাসা, গুনাইবিবির মতো মনমাতানো সব যাত্রাপালা দেখার জন্য এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা বিনিদ্র রজনী কাটাত। তখন হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও যাত্রাপালার প্যান্ডেলের সামনে রাতভর বসে থাকা ছিল এ দেশের চিরায়ত সংস্কৃতিরই একটি অংশ। যাত্রা শিল্পীদের নাচ-গান, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভরাট কণ্ঠের উচ্চ আওয়াজের কাঁপা কাঁপা সংলাপ আর বিবেকের করুণ সুরে শীতের তীব্রতার মধ্যেও যাত্রার অনুরাগীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ত শিল্পের উষ্ণতা। রাতভর যাত্রা দেখে ভোরবেলায় বাড়ি ফেরাই ছিল রূপসী বাংলার সংস্কৃতির সৌন্দর্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে গর্ব করার মতো বাঙালির নিজস্ব এই সংস্কৃতি বর্তমানে মরতে মরতে খুব করুণ ও অসহায়ভাবে বেঁচে আছে। বলা চলে, যাত্রা এখন সংস্কৃতির আইসিইউতে রয়েছে। আর মৃতপ্রায় এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে দেশের সংস্কৃতির সূতিকাগার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।  শেকড়ের এই লোকসংস্কৃতিকে রক্ষা করে এটিকে নতুন করে চাঙা করার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকেই বেছে নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। সংস্কৃতির নানা ধারার পাশে থেকে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি যাত্রাপালা নতুন করে ডালপালা ছড়াক এমন লক্ষ্য নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি এগিয়ে এসেছে যাত্রাশিল্পের উন্নয়ন, বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধিতে। যাত্রাপালার উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবিতকরণের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী নিবন্ধিত ৮২টি যাত্রাদল। ১০ জন নির্দেশক এবং সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ে নতুন ৯৯টি যাত্রাপালা নির্মাণ ও মঞ্চায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে শিল্পকলা কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে দেশব্যাপী নতুন যাত্রাপালা নির্মাণে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ২ লাখ এবং আড়াই লাখ টাকা করে ছাড় প্রদান করা হয়েছে। যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় মঞ্চায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে, মুজিববর্ষ ও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে লালপুর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দী জীবন নিয়ে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি ‘নিঃসঙ্গ লড়াই’ নামের একটি যাত্রাপালা মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। মাসুম রেজার রচনায় ওয়াহিদা মল্লিক জলির নির্দেশনায় প্রযোজনাটির উপদেষ্টা শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। আর প্রযোজনা সমন্বয়কারী হিসেবে রয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির সেট ডিজাইনার পূর্ণলাক্ষ চাকমা। বর্তমানে যাত্রাপালাটির মহড়া শুরু হয়েছে। এ ছাড়া দেশের যাত্রাদলগুলোকে নিবন্ধনের লক্ষ্যে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সাত দিনব্যাপী ১৩তম যাত্রা নিবন্ধন উৎসব-২০২১। একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারের এই উৎসবে দেশের প্রায় ৪০টি যাত্রাদল অংশগ্রহণ করবে। নিবন্ধনকৃত দলগুলোর পরিবেশনায় আগামী বছর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির সেট ডিজাইনার পূর্ণলাক্ষ চাকমা। যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০১২ এর আলোকে নিবন্ধনের মাধ্যমে এর আগে ১৩০টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ৬৪ জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করতে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। আর প্রত্নযাত্রা ‘ঈশা খান’ নির্মাণ ও প্রদর্শনীর মাধ্যমে যাত্রার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের ভিন্ন চিন্তা রয়েছে বলেও জানায়  শিল্পকলা একাডেমি। যাত্রার উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নামের যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনী, ১০০টি দেশীয় যাত্রাপালা ও শতাধিক ভারতীয় যাত্রাপালা সংগ্রহ, ১০০টি দেশীয় যাত্রাপালা ১৯ জন বিশিষ্ট গবেষক/লেখক দ্বারা মূল্যায়ন, যাত্রা পালাকারদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন, কর্মশালাভিত্তিক পাঁচটি যাত্রা প্রযোজনা নির্মাণ ও প্রদর্শনী, সারা দেশ থেকে নিবন্ধিত যাত্রা দলগুলোর স্বত্বাধিকারী, ম্যানেজার, অভিনয়শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীর সঙ্গে নিয়মিতভাবে মতবিনিময় সভার আয়োজন।

এদিকে, নিবন্ধনের শর্তাবলি যাত্রা দলগুলো যথাযথভাবে পালন করছে কিনা তার প্রতিবেদনের জন্য  স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে তদারকি করা হবে বলেও জানায় সংশ্লিষ্টরা।

আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ততা ও নেটদুনিয়ার ভাইরাল ও ভিউর উন্মাদনার অপসংস্কৃতির মধ্যেও বেঁচে  থাকুক বাঙালির নিজস্ব স্বকীয়তা, আবহমান এই সংস্কৃতি।

 

সর্বশেষ খবর