মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

যে গল্পে দর্শক ফিরবে সিনেমা হলে

আলাউদ্দীন মাজিদ

যে গল্পে দর্শক ফিরবে সিনেমা হলে

চলচ্চিত্রকার আর দর্শকদের একটিই কথা-‘ভালো গল্প আর মানসম্মত ছবি পেলে দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করে।’ এ কথার প্রমাণও মিলেছে দেশীয় চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন থেকে। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মিত হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে নব্বই দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত ছবির গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শকদের সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেত। জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের ছবিতে নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র দেখতে পেয়ে আপ্লুুত দর্শক হেসে-কেঁদে সিনেমা হল থেকে বের হতো। একটি ছবি বারবার দেখত। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র প্রয়াত আবদুল জব্বারের ‘মুখ ও মুখোশ’। একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল পারিবারিক গল্পের ছবি। একটি সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী গল্প পেয়ে দর্শক সাদরে গ্রহণ করে ছবিটি। এ ধারাবাহিকতায় নির্মিত হতে থাকে এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, সুতরাং, বেহুলা, মনের মতো বউ, নয়নতারা, রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতি, ছুটির ঘণ্টা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, হাজার বছর ধরে, হাছন রাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা, মনপুরা প্রভৃতি ছবি। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে এই চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। ওই সময় থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রের গল্প দর্শকদের আর কাছে টানতে পারছে না। কারণ ছবির গল্প হয়ে পড়েছে ভিনদেশি সংস্কৃতির নিম্নগামী অনুকরণ। এ সময়ের সিংহ ভাগ ছবিতে ছিল না রুচি, মান আর সুনির্মাণ। এমন গল্পে বাঙালির জীবনবোধের চিত্র ছিল না। ফলে দর্শকও হয় হতাশ। আশার কথা, মানের এই খরার মাঝেও মাঝে মধ্যে দু-একটি মানসম্মত ছবি আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে ২০০০ সালের পর থেকে নির্মিত মোল্লা বাড়ীর বউ, হৃদয়ের কথা, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, শিকারি, ছুঁয়ে দিলে মন, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, ঢাকা অ্যাটাক, সত্ত্বা, টেলিভিশনসহ বেশ কিছু বাণিজ্যিক ধারার ছবি। এ ছবিগুলোই প্রমাণ করে দেয় ভালো গল্পের মানসম্মত ছবি পেলে দর্শক পরম নির্ভরতা নিয়ে সিনেমা হলে ফিরে আসে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘মিশন এক্সট্রিম’ শিরোনামের ছবিটিতেও দর্শক খুঁজে পেয়েছে এ সময়ের ধ্যান জ্ঞান। তাই দীর্ঘদিন পর এমন একটি ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছে দর্শক। আসলে কেমন গল্পে সিনেমা হলে ফিরবে দর্শক? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শি^কতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। এক সময় সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ জামান চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, আশীষ কুমার লোহ, এটিএম শামসুজ্জামান, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, এস এম পারভেজ, আবদুল জব্বার খান, আমজাদ হোসেনের মতো গল্পকারদের গল্পে কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। এখন গল্পকারের আকাল চলছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাই সেখানেও বাণিজ্যিক এবং মৌলিক, উভয় ধারার সমৃদ্ধ সময়োপযোগী গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। যা ঢাকাই চলচ্চিত্রে নেই। মানে গল্প আর গল্পকারের সংকটে পড়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা মৌলিক গল্প বিবর্জিত হিন্দি ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে গাঁজাখোরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। এ অবস্থা এখনো চলছে। এরপর শুরু হয় অশ্লীলতার দাপট। মাঝে মধ্যে দু-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। আর এ ভালো ছবিগুলোই খরার মাঝে স্বস্তির বৃষ্টি বয়ে আনে। আরেক বলিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান বলেন, একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো- নানা-নানি, দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাইবোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এ কারণেই পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ছিল স্বর্ণালি যুগ। পরবর্তীতে মৌলিক গল্পকারের কাছে নির্মাতারা না গিয়ে বিদেশি ছবি নকল করা এখনকার জীবনঘনিষ্ঠ গল্প থেকে সরে আসায় দর্শক এসব ছবি প্রত্যাখ্যান করা শুরু করে। চলচ্চিত্রের সুদিন ফেরাতে দরকার নিজস্ব গল্পের মানসম্মত নির্মাণ। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এ সমৃদ্ধতা গড়ে উঠেছে নিজস্ব গল্প, সংস্কৃতির ছাপ আর পারিপার্শ্বিক ছায়ার ওপর ভর করে। এ কারণেই এদেশের ছবি এক সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসায় ভাসত, দেশের দর্শক আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে ছবি ঘরে ছুটে গিয়ে নিজের জীবনকে রুপালি পর্দায় খুঁজে পেয়ে তৃপ্ত হতো। সেই অবস্থা ফেরানো কঠিন নয়, বিবেক আর মেধাই এর জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে দেশপ্রেম যুক্ত হলে একজন নির্মাতা অবশ্যই একটি মানসম্মত দেশি ছবি নির্মাণ করতে পারবেন আর দর্শক সেই ছবি পেয়ে নির্র্দ্বিধায় হলে ফিরবে।

সর্বশেষ খবর