শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
নাটকের বাজেট কমছে

বাড়ছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের পারিশ্রমিক

বাড়ছে কেন্দ্রীয় চরিত্রের পারিশ্রমিক

বর্তমানে টিভিতে প্রতিদিন এক ঘণ্টা, ধারাবাহিক, সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টি নাটক প্রচার হয়। এসব নাটকে নেই আগের সেই জৌলুস। কেন? উত্তর খুব সহজ। অধিকাংশ নাটকে নেই গল্প, নেই শিল্পীদের অভিনয়ে কোনো প্রাণ। নাটকের এ বেহাল দশার অন্তরালে যে সমস্যাটি বারবার সামনে এসেছে, তা হলো বাজেট স্বল্পতা। আর যদি নাটকে মোট বাজেটের ৭০ ভাগ টাকা চলে যায় দুই শিল্পীর পকেটে, ভালো নাটক হবে কী করে। এসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন- আলী আফতাব  

 

এক ঘণ্টার একটি নাটকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় ৭০ শতাংশই মাত্র দুই তারকার পারিশ্রমিক হিসেবে গুনতে হচ্ছে প্রযোজকদের। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে নাটক বানাতে হিমশিম খাচ্ছেন বেশির ভাগ নির্মাতা। নাটকের গল্পে দুই তারকার বাইরে দুয়েকজন সহশিল্পী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নাটক নির্মাণে আপস করছেন অনেক নির্মাতা। ফলে, নাটক মানেই তরুণ-তরুণীর প্রেম কিংবা হা-হা হি-হি কমেডি। যে কারণে টিভিতে বেশির ভাগ সময় নায়ক-নায়িকা আর কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে পারা অভিনেতাদেরই আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ভালো গল্প আর চরিত্রের অভাবে শক্তিশালী অনেক প্রবীণ অভিনয়শিল্পীর পর্দায় উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে।

নাটকের বাজেট কমছে। বাড়ছে কেবল কেন্দ্রীয় চরিত্রের পারিশ্রমিক। আর বাজেট কম হওয়ায় বেশির ভাগ নাটকের গল্প আটকে থাকছে শোবার ঘর, অফিস কক্ষ ও পার্কের বেঞ্চিতে। নাটক হয়ে যাচ্ছে পরিবারহীন। টিভি নাটক পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টর্স গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘পাঁচ বছর আগেও যে নাটকের বাজেট ছিল ৩ লাখ টাকা, সেই নাটকের বাজেট এখন কমে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। নাটকের দাম কমলেও তারকাদের পারিশ্রমিক বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ পর্যন্ত। একটি নাটকের জন্য যে বরাদ্দ, তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ টাকা চলে যাচ্ছে তাঁদের সম্মানী দিতে।’

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তারকাদের পারিশ্রমিক দিতে নাটকের আত্মীয়স্বজন, গৃহকর্মী, প্রতিবেশীর চরিত্রগুলো গল্প থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বাংলা নাটক ক্রমে পরিবারকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘যাঁর চাহিদা আছে, তাঁর পারিশ্রমিক বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা অন্য সময়ও ছিল। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের নাটকের বাজেট অনেক কম। নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে, তা না হলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পগুলো হারিয়ে যাবে।’ অন্যদিকে, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক অসংগতির জন্য বিজ্ঞাপনের বাজেট কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। আর বিজ্ঞাপনদাতারা দায়ী করছেন চ্যানেলগুলোর দর্শক হারানোকে। আবার অনেকেই বলছেন, টেলিভিশন চ্যানেল নাটকের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোর কাছে নিজেদের চাংক (অনুষ্ঠান প্রচারের সময়) বিক্রি করে দিচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ক্রেতা প্ল্যাটফরমগুলো একই ঘরানার গল্প, চরিত্র, পোশাক, লোকেশনের বাছবিচার না করে ‘ভিউ’-এর আশায় তাদের সুবিধামতো তারকাদের নিয়ে নাটক বানাচ্ছে। ফলে একই তারকা ঘুরেফিরে বারবার পর্দায় ফিরে আসছেন।

তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয় মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, আফরান নিশো, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মম, মেহজাবীন চৌধুরী, তৌসিফ মাহবুব, সাফা কবির ও তানজিন তিশাকে। এ নামগুলো জানিয়েছেন এখনকার সময়ের বেশ কজন ব্যস্ত নির্মাতা, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এ ছাড়া কিছু অনলাইন প্ল্যাটফরম ও টিভি চ্যানেলের কর্মকর্তারাও বলেছেন এ নামগুলোই।

অভিযোগের তীর যখন ছুটছে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের দিকে, তখন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রিয় এক অভিনেতা বলেন, ‘শিডিউল নিতে এসে প্রথমেই নির্মাতা এবং প্রযোজক বলেন, “ভাই বাজেটের কোনো সমস্যা নেই”। আমি নিজেই ভাবী, এত টাকা তাঁরা কোথা থেকে দিচ্ছেন? টাকাটা উঠেই বা আসছে কীভাবে!’ 

অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এখন নাটক নির্মাণ করছি না। এর কারণ দুটো চরিত্র যদি সব টাকা নিয়ে যায় তাহলে কীভাবে বাকি শিল্পীদের টাকা দেব? অনেকেই দুই শিল্পী নিয়ে নাটক নির্মাণ করছেন, কিন্তু আমি তো তা পারি না।’ নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, ‘এখনকার নাটকগুলোর গল্পে কোনো ভিন্নতা না থাকার কারণ, যাঁদের হাত ধরে নাটকের গল্পে পরিবর্তন হয়েছিল, তাঁরা এখন মিডিয়ার অস্থিরতার কারণে নাটক বানানো থেকে দূরে চলে গেছেন। ভালো বাজেট না পেলে তাঁরাও নির্মাণে আসছেন না।’ তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘নাটকের গল্প অনুযায়ী বাজেট দিতে হবে। গল্পের দৃশ্যায়ন যদি থাকে সুন্দরবনে, বান্দরবানে; আবার শুটিং স্পট যদি হয় উত্তরা; এ দুই নাটকের বাজেট নিশ্চয়ই এক হবে না।  যোগ্য লোক দিয়ে কাজ করালে নিশ্চয় তাঁর জন্য খরচ বেশি হবে।’ আর সবাই মনে করেন, বাজেটের সঙ্গে মিল রেখে  নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক হওয়া প্রয়োজন। 

সর্বশেষ খবর