রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

পুরনো গানের নতুন বাণিজ্য

অস্তিত্ব হারাচ্ছে গানের পরিচয়

আলী আফতাব

পুরনো গানের নতুন বাণিজ্য

সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বহু বছরের পুরনো গান কাভার করা হলে ভালো। কিন্তু কিছু অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে, অনেক কালজয়ী গান সংরক্ষিত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি শিল্পীও জানে না এই গানের স্রষ্টা কে? অনেক সময় মূল শিল্পীর অনুমতিও নেওয়া হয় না।

 

একটি গান তখনই কালজয়ী হয়, যখন সেই গানটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখে। অনেকে তো এসব কালজয়ী গান গেয়ে শিল্পীও হয়ে গেছেন, জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। মানে সিনিয়রদের গান গেয়ে নতুন শিল্পীরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন- এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আবার এটাও ভুল নয় যে, নতুনদের মাধ্যমেই জনপ্রিয় গানগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। নতুনরা নিয়মিত বিভিন্ন রিয়েলিটি শো, স্টেজ কিংবা টিভি লাইভে কাভার করছেন শ্রুতিমধুর কালজয়ী গানগুলো। নতুনরাই শ্রোতা-দর্শকের জন্য কাভার করে সেগুলো আপলোড করছেন ভিডিও দেখার সাইট ইউটিউবে। কেউ কুড়াচ্ছেন বাহবা কেউ হচ্ছেন বিতর্কিত।

অন্যদিকে সংগীতশিল্পীরা তাদের প্রিয় শিল্পীর গান ভালোবেসে ট্রিবিউট করেন। যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে এমনটা। বিশেষ করে নব্বই দশক থেকেই পুরনো গানের রিমেক করার প্রবণতা শুরু হয় এ দেশে। বেবী নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী, কনকচাঁপা, দিলরুবা খান, মমতাজ, খালিদ হাসান মিলু, ফেরদৌস ওয়াহিদ, রিজিয়া পারভীন, সেলিম চৌধুরী, আগুন, পলাশ, খালিদ, রবি চৌধুরী, মামুন, অণিমা লিজা ডি কস্টা, আরিফ, নাজির মাহমুদসহ অনেক শিল্পী ফোক ও সিনেমার গানের রিমেকে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনেক অনুষ্ঠানে রিমেক করা হচ্ছে পুরনো গান। এমনকি এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বহু বছরের পুরনো গান কাভার করা হলে ভালো। কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলোতে দেখা যাচ্ছে অনেক কালজয়ী গান সংরক্ষিত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি শিল্পীও জানে না এই গানের স্রষ্টা কে? পুরনো গানের নতুন এই বাণিজ্য শুরু করেছে বেশ কিছু টিভি চ্যানেল ও ইউটিউব চ্যানেল। যেমন ‘সিলন মিউজিক লাউঞ্জ’, ‘আইপিডিসি আমাদের গান’, ‘ফোক স্টেশন’সহ বেশ কিছু আয়োজনে নতুন আঙ্গিকে পুরনো গানের পরিবেশনা চোখে পড়েছে। এসব অনুষ্ঠানে প্রচারিত গানগুলোর রয়্যালিটি থেকে বঞ্চিত হয় শিল্পীর পরিবার। এ ছাড়া এক-দুটি গান নিয়ে ইতোমধ্যে কপিরাইট জটিলতাও তৈরি হয়েছে।

ফলে সংগীত সংশ্লিষ্ট অনেকে এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন যে, এভাবে পুরনো গান গাওয়া কতটুকু যৌক্তিক? শুধু টাকা কামানোর জন্যই কি এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ঠিক হয়েছে?

অন্যদিকে গানের রয়্যালটি ও কপিরাইট স্বত্ব নিয়ে জটিলতা যেন কাটছেই না। দিন যত গড়াচ্ছে, সংগীত সংশ্লিষ্টদের মনে দানা বাঁধছে ক্ষোভ। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে গীতিকবি সংঘ, কপিরাইট অফিসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সংগঠন। তবু  কোনো আলোর রেখা মিলছে না।

সেই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ মিলল দেশের নন্দিত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কণ্ঠে। শুক্রবার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার অগ্রজ, প্রয়াত কবি অধ্যাপক ড.  মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ বেতারের একজন বিশিষ্ট গীতিকার ছিলেন। এখনো তাঁর রচিত অনেক গানই  বেতার ও টেলিভিশন  থেকে প্রচার হয়। তাঁর মৃত্যুর পর গানের রয়্যালটি স্ত্রী রাশিদা জামান প্রাপ্য হবে বলে তিনি তার রয়্যালটি ফরমেই উল্লেখ করে যান। বেতারে আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের চাকরি জীবনে দেখে এসেছি, প্রতি তিন মাস অন্তর রয়্যালটি  চেক প্রাপকের ঠিকানায় ডাকযোগে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এখন প্রাপককেই তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটির জন্য বেতারে গিয়ে ধরনা দিতে হয়। এটি খুবই দুঃখজনক।’

তিনি আরও লেখেন, ‘তাঁর বর্তমান বয়স ৮৪ বছর। বছরের পর বছর তিনি কোনো রয়্যালটি চেক পান না। এই বয়সে, তাঁর পক্ষে বেতার ভবনে গিয়ে ধরনা  দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি তিনি তাঁর স্বামীর রচিত গানের রয়্যালটি থেকে বঞ্চিতই রয়ে যাবেন? এমন অবস্থা শুধু তাঁর নয়, অসংখ্য উত্তরাধিকারীর।’ উল্লেখ্য, ব্যান্ড মিউজিকের ক্ষেত্রে কাভার গান গাওয়া নিয়ে শিল্পীরা সচেতন। এমনকি ২০২০ সালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যান্ড মিউজিকের সংগঠন বামবা জানায়, বামবার সদস্যভুক্ত ব্যান্ডের অত্যন্ত জনপ্রিয় গানগুলো অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন শিল্পী/ব্যান্ড, বিভিন্ন কনসার্ট, টিভি প্রোগ্রাম, টিভি রিয়েলিটি শো ও ইন্টারনেটভিত্তিক অন্যান্য সম্প্রচারমাধ্যমে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবেশন করছে। ব্যান্ড দলের অনুমতি ছাড়া যা অনৈতিক ও বেআইনি। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবেশন বা সম্প্রচারের জন্য অনুমতি অত্যাবশকীয়।  অন্যদিকে অডিও গানের প্রযোজকরা এখন নাটক নির্মাণে বেশি লগ্নি করছেন। এ কারণে মানসম্পন্ন গান তৈরি হচ্ছে না। তবে থেমে নেই জনপ্রিয় শিল্পীরা। ব্যক্তি উদ্যোগে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একের পর এক কাভার গান প্রকাশ করে যাচ্ছেন তারা। গত বছরজুড়ে অনেক শিল্পীর বেশ কিছু মৌলিক গান প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু জনপ্রিয়তা পায়নি তেমন কোনো গান। সব সময়ের মতো আলোচনয় ছিল পুরনো গানগুলো। শুধু ইউটিউবে নয়, স্টেজেও এ প্রজন্মের শিল্পীরা বেশির ভাগই কাভার করে    থাকেন। অনেক সিনিয়র শিল্পী নিজেদের দুই- একটি মৌলিক গান গাইলেও বেশির ভাগ সময়ে গেয়ে থাকেন পুরনো কাভার গান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিছু নতুন শিল্পী বলেন, ‘আমরা যখন স্টেজে উঠি, আমাদের রিকোয়েস্ট করা হয় পুরনো গানগুলোর। আর স্টেজে সব সময় শ্রোতাদের পছন্দের গানগুলোই গাইতে হয়।’ এ বিষয়ে ফাহমিদা নবী বলেন, ভিউ প্রতিযোগিতা, অন্যের গান কাভার করে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া- এসবই আমাদের সুষ্ঠু সংগীতের বিকাশে বড় বাধা। এক দিনে তারকা বনে গেলে খুব তাড়াতাড়িই সে পড়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সর্বশেষ খবর