মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ছবির কোনো খবর নেই , সমিতি নিয়েই যত ব্যস্ততা

ছয় সমিতির কাছে এফডিসির বকেয়া পাওনা প্রায় ৭ কোটি টাকা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবির কোনো খবর নেই , সমিতি নিয়েই যত ব্যস্ততা

চলচ্চিত্রশিল্পে দীর্ঘদিন ধরে ছবি নির্মাণ আর প্রদর্শনের খরা চলছেই। এই দীর্ঘ খরায় শিল্পটি বলতে গেলে একেবারে কোমায় চলে গেছে। করোনার কারণে দুই বছর ধরে সিনেমা হল প্রায় বন্ধ। চলচ্চিত্র না থাকায় চলচ্চিত্রের মানুষ বেকার হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। তাতে কী? সমিতি আছে না! চলচ্চিত্রের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে মাথাব্যথা না থাকেলেও সমিতি আর নেতৃত্ব নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা। মানে নীরব চলচ্চিত্র আর সরব সমিতি। চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার খ্যাত সংস্থা হচ্ছে এফডিসি, যা কেপিআইভুক্ত এলাকা বলে এখানে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন- এফডিসিতে কোনো সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের অফিস করা যাবে না। এমনকি এখানে এমন কোনো কার্যক্রমও চালানো বেআইনি। তা সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে এখানে সবই চলছে। চলচ্চিত্রের কাজ বা উন্নয়ন না থাকলেও চলচ্চিত্রের রয়েছে কমপক্ষে ১৯টি সমিতি। এই সমিতিগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রদর্শক সমিতি ছাড়া বাকি সব সংগঠনের অফিস বহাল তবিয়তে এফডিসিতেই রয়েছে। এফডিসির বিশাল এলাকায় থাকা এসব সমিতি এফডিসিকে বছরের পর বছর অফিস ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ, বিদ্যুৎ ও পানির বিল না দিয়ে দেদার নানা কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে যাওয়ায় আয় প্রায় না থাকায় এফডিসি দীর্ঘদিন ধরে অনেক কষ্টে এফডিআর ভাঙিয়ে আর সরকারি প্রণোদনা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করছে। অথচ এফডিসিতে অবস্থিত সমিতিগুলোর মধ্যে ছয়টি সমিতির কাছেই এখন পর্যন্ত এফডিসি পাবে অফিস ভাড়া ও নানা বিল বাবদ প্রায় ৬ কোটি, ৬৬ লাখ, ৮ হাজার ৯৩ টাকা। যার মধ্যে পরিচালক সমিতির কাছে ২৬ লাখ ৭ হাজার ১৪৫ টাকা, শিল্পী সমিতির কাছে ১৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৫ টাকা, চলচ্চিত্র গ্রাহক সমিতির কাছে ৮ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা, ফিল্ম এডিটরস গিল্ডের কাছে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫৬ টাকা, চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপক সমিতির কাছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৪ টাকা এবং সিডাবের কাছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৯ টাকা। এফডিসি প্রশাসন জানায়, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও সমিতিগুলো এতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করে না। এর ফলে অডিটের সময় সমস্যার কবলে পড়ে এফডিসি। এফডিসি প্রশাসন বলছে এই বকেয়া পাওনা যদি সমিতিগুলো পরিশোধ করে ও নিয়মিতভাবে ভাড়া ও অন্যান্য খরচ দিয়ে দেয় তাহলে এই লোকসানি প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছে, চলচ্চিত্র নির্মাণে সমিতির কী দরকার? কাজ করলেই তো চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হয়। সমিতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কতিপয় চলচ্চিত্রের মানুষের কাজ হচ্ছে কীভাবে নেতা হওয়া যায়, প্রতি বছর সমিতির নামে বনভোজন, ইফতার পার্টি, নির্বাচনের আয়োজনসহ নানা ফায়দা হাসিলের প্রকল্প বের করে নানা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলে নিজেদের পকেট ভর্তি করা। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে চলচ্চিত্রের কতিপয় মানুষের  কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবাই ব্যস্ত সমিতি আর নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে। এক সমিতি আরেক সমিতিকে কীভাবে ঘায়েল করবে সেটিও কালচারে পরিণত হয়েছে। একটি সমিতির এক কর্মকর্তা সমিতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে নানা আয়োজনের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা তুলে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন বলেও প্রচার আছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনের জন্য সমিতির প্রয়োজন কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশে এমন কি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও চলচ্চিত্র সমিতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ভারতজুড়ে চলচ্চিত্রের স্বার্থ রক্ষায় রয়েছে একটি মাত্র সংগঠন। যার নাম হলো ‘ইন্ডিয়ান মোশান পিকচার অ্যাসোসিয়েশন’ (ইমপা)। আর আমাদের মতো ছোট একটি দেশে রয়েছে চলচ্চিত্রের কম করে হলেও ২০টি সমিতি। এফডিসি দীর্ঘদিন ধরে এসব সমিতির ভারে জর্জরিত। সেখানে কতিপয় চলচ্চিত্রের মানুষ যান গালগল্প, এক সমিতি অন্য সমিতি এবং এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাদা  ছোড়াছুড়ি, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে জড়িত হতে। এফডিসিতে এখন কোনো চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টকে ‘কি কাজ করছেন’ এমন প্রশ্ন করা হলে জবাব পাওয়া যায়, ‘নারে ভাই, হাতে কোনো কাজ নেই, এখানে এসেছিলাম অমুক সমিতিতে যাওয়ার জন্য, সেখানে বসে একটু গল্প করব, সময় কাটাব, এই আর কি?’ এ কারণে এফডিসিকে এখন চলচ্চিত্রপাড়ার পরিবর্তে সমিতিপাড়া নামেই আখ্যায়িত করছেন অনেকে। অনেকের প্রশ্ন এফডিসি হলো কেপিআইভুক্ত এলাকা। কেপিআইভুক্ত এলাকায় কি করে সমিতি থাকতে পারে। সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব কেন? সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এফডিসিতে আসলে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর আলাপ আলোচনার জন্য ‘স্টাডি রুম’ করা যায়। সমিতি নয়। আশির দশকে স্টাডি রুম করতেই পরিচালক, শিল্পী, প্রযোজকসহ অনেককে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে স্টাডির কোনো নামগন্ধও নেই। দিব্যি সমিতির নাম ব্যবহার করে অফিস ব্যবহার, নির্বাচন, মামলা, মিছিল মিটিংসহ নানা কাজ করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা দেখেও না দেখার ভান করে আসছে।

সমিতি নিয়ে সমিতির কর্তাদেরই বক্তব্য হলো- সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা করাই মূলত সমিতির দায়িত্ব। এমন কথায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাধারণ সদস্যরা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনই যদি না থাকে তাহলে সদস্যদের স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষণ সম্ভব। ভিক্ষাবৃত্তি করে আর কত চলা যায়, এতে তো চলচ্চিত্রকারদের মানসম্মান বজায় থাকে না। তাই সমিতি নয়, আগে কাজ চাই।

সর্বশেষ খবর