রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তি আটকে থাকা অর্ধশত ছবির ভবিষ্যৎ কী

আলাউদ্দীন মাজিদ

মুক্তি আটকে থাকা অর্ধশত ছবির ভবিষ্যৎ কী

‘এভাবে আর কত অপেক্ষা করা যায়। কারণ এর সঙ্গে অর্থ যুক্ত আছে। ওয়েব প্ল্যাটফরমগুলো যদি সঠিক মূল্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দেয় তাহলে ওটিটিতে ছবি মুক্তি দিয়ে নির্মাতারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। কারণ নির্মিত ছবিগুলো মুক্তির ব্যবস্থা করতে না পারলে নির্মাতারা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে ও নতুন করে কোনো নির্মাতা আর ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসবেন না। এতে চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এ হতাশা একজন নির্মাতার। তিনি হলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলীমউল্লাহ খোকন। তার মতো অন্য ছবির নির্মাতাদেরও একই ক্ষোভ আর হতাশা।

২০২০ সালে মহামারি করোনা শুরু হলে চলচ্চিত্র মুক্তি আটকে যায়। এর ফলে গত দুই বছর ধরে আটকা পড়ে আছে প্রায় অর্ধশত ছবি।

গত ৭ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ২০২০ সাল থেকে করোনার কারণে আটকে পড়া ‘শান’ ছবিটি। জাঁকালো আয়োজনে ছবিটি মুক্তি উপলক্ষে ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংবাদ সম্মেলনও। কিন্তু  হঠাৎ করে করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ বেড়ে যাওয়ায় মুক্তি স্থগিত করা হয় ছবিটির। ছবির পরিচালক এম রাহিম চরম দুঃখ নিয়ে বলেন, ‘ছবিটির মুক্তিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে ‘শান’ আর ৭ জানুয়ারিতে মুক্তি পেল না। ছবিটি করোনার কারণে মুক্তি দিতে পারছি না বলে সত্যিই আমি খুব মর্মাহত।’

করোনার ভয়াবহতায় চলচ্চিত্র শিল্প বলতে গেলে চলে গেছে কোমায়। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস করোনার কারণে সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ থাকে। ১৬ অক্টোবর সিনেমা হল খুললেও বেশিরভাগ প্রযোজক ছবি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তাদের কথায় করোনার ভয়ে সিনেমা হলে দর্শক কতটা আসবে তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। তার ওপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমা হলের অর্ধেক আসন খালি রাখতে গিয়ে চলচ্চিত্রে লগ্নিকৃত অর্থ কতটা ফেরত আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

২০২১ সালের মার্চে সরকার আবার করোনা সতর্কতার লকডাউন জারি করলেও এ সম্পর্কিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে সিনেমা হল বন্ধের কথা উল্লেখ ছিল না। তাই গত বছরের রমজানের ঈদে ‘সৌভাগ্য’ শিরোনামে একটি নতুন ছবি মুক্তি দিলেও স্থানীয় জেলা প্রশাসন ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ স্থানে করোনার কারণে সিনেমা হল খুলতে বাধা দেয় এবং ‘সৌভাগ্য’ ছবিটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এতে অন্য প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিতে লোকসানের ভয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেশ-বিদেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হলে প্রযোজকরা আবার ছবি মুক্তি দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথমেই দীপংকর দীপেন তার ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবিটি ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। অনন্ত জলিল ২৪ ডিসেম্বর তার ‘দিন : দ্য ডে’ ছবিটি মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেন। সোহানী হোসেন প্রযোজিত ও সুমন ওয়াজেদ পরিচালিত শাকিব খান ও দর্শনা অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’ ছবিটির মুক্তি তারিখও ঘোষণার প্রস্তুতি চলছিল। মোস্তাফিজুর রহমান মানিক জানিয়েছিলেন, নতুন বছরই ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ ছবিটি মুক্তির তারিখ ঘোষণা করা হবে। নির্মাতা সৈকত নাসিরসহ অন্য আটকে থাকা ছবিগুলোর নির্মাতারাও জানান, করোনা পরিস্থিতির আর অবনতি না হলে তারা তাদের ছবিগুলো মুক্তি দেওয়া শুরু করবেন। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, ‘বিদ্রোহী’, ‘বর্ডার’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘কমান্ডো’, ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’, ‘সাইকো’, ‘সাহসী যোদ্ধা’, ‘তালাশ’, আশরাফ শিশির পরিচালিত ‘৫৭০’, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘পাপ-পুণ্য’, মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’, সৈকত নাসির পরিচালিত ‘ক্যাসিনো’, মাহমুদ দিদার পরিচালিত ‘বিউটি সার্কাস’, রায়হান রাফি পরিচালিত ‘দামাল’, ‘আদম’, ‘জ্যাম’, ‘গাঙচিল’, ‘বীরত্ব’, ‘ঢাকা ২০৪০’, ‘গিরগিটি’ সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের মুক্তি প্রায় দুই বছর ধরে আটকে আছে শুধু করোনার ভয়াবহতায়। এভাবেই মুক্তির তালিকায় থাকা অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্র আটকে আছে করোনার কারণে। ২০২০ সালে মুক্তির তালিকায় থাকা প্রায় অর্ধশত চলচ্চিত্রের মধ্যে আলোর মুখ দেখেছিল ১৫টি। ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র। গত দুই বছরে স্বল্প বাজেটের কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেলেও বিগ বাজেটের তারকাবহুল ছবি বলতে গেলে মুক্তি পায়নি। ২০২০ সাল থেকে ছবির প্রধান দুই ঈদে ‘সৌভাগ্য’ ছাড়া আর কোনো নতুন ছবি মুক্তি পায়নি। প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, করোনার কারণে নির্মাতাদের মতো আমরা সিনেমা হল মালিকরাও খুবই দুরবস্থায় আছি। ব্যবসাশূন্য অবস্থায় বসে বসে সিনেমা হল মেনটেইনেন্স ব্যয় বহন করতে গিয়ে চরম লোকসানে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে চলচ্চিত্র ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না। প্রখ্যাত নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’ নির্মাণ করে বসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। করোনার কারণে তিনিও ছবিটি নিয়ে আটকা পড়েছেন। তার কথায়, এটি আরটিভির প্রযোজিত ছবি। তারা ছবিটি কীভাবে মুক্তি দেবেন তা আমি জানি না। অনেকে এখন অনলাইন প্ল্যাটফরমের দিকে এগোচ্ছেন। আমার কথা হলো, বড় পর্দার জন্য নির্মিত ছবি অনলাইনে মুক্তি দিয়ে সেই ফ্লেভার দর্শক পাবেন না। তাই আমি এ ছবিটি অনলাইনে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে নই। চলচ্চিত্র-নির্মাতা অনন্য মামুন বলেন, এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ করোনার কারণে কখনো সিনেমা হল বন্ধ থাকে, আবার খুললেও দর্শক সিনেমা হলে যায় না। এমন অচলাবস্থা চলতে থাকলে নির্মাতারা ছবি নির্মাণ কীভাবে করবেন। তাই সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এ মুহূর্তে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ছবি যদি নির্মাণ শেষে দীর্ঘদিন ধরে মুক্তি না পায় তা হলে আশপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি ও ঘটনা আবহ বদলে যাওয়ার কারণ সেই ছবি আর দর্শক দেখে না, কারণ এতে আর সমসাময়িক কোনো চিত্রই থাকে না। ফলে পড়ে থাকা ছবিটির ম্যারিট নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে ছবিটির নির্মাতা। গত দুই বছর ধরে করোনা মহামারি সেই ক্ষতিকে তীব্র করে তুলেছে।

সর্বশেষ খবর