মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সিনেমার কোনো খবর নেই কাদা ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমার কোনো খবর নেই কাদা ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত

চলচ্চিত্র শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে ছবি নির্মাণ আর প্রদর্শনের খরা চলছেই। এই দীর্ঘ খরায় শিল্পটি বলতে গেলে একেবারে কোমায় চলে গেছে। করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে সিনেমা হল প্রায় বন্ধ। চলচ্চিত্র না থাকায় চলচ্চিত্রের মানুষ বেকার হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছে। চলচ্চিত্রের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে মাথাব্যথা তো নেই-ই, উপরন্তু তাঁরা দলাদলি আর কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। গত কয়েক দিন ধরে এফডিসি ও চলচ্চিত্রপাড়ায় চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে চলচ্চিত্রবোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে- ‘দেশীয় চলচ্চিত্র এখন কোন পথে?’ চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার বলে খ্যাত সংস্থা হচ্ছে এফডিসি, যা কেপিআইভুক্ত এলাকা বলে এখানে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন এফডিসিতে কোনো সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের অফিস করা যাবে না। এমনকি এখানে এমন কোনো কার্যক্রম চালানোও বেআইনি। তা সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখানে সবই চলছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে চলচ্চিত্রের কতিপয় মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁরা সবাই ব্যস্ত নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে। একজন আরেকজনকে কীভাবে ঘায়েল করবে সেটিও কালচারে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর প্রদর্শনের কোনো খবর নেই। অথচ এফডিসি দীর্ঘদিন ধরে অন্য কাজের ভারে জর্জরিত। সেখানে কতিপয় চলচ্চিত্রের মানুষ যায় গালগল্প, এক সমিতি অন্য সমিতি এবং এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে জড়িত হতে। এফডিসিতে এখন কোনো চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টকে ‘কী কাজ করছেন’ এমন প্রশ্ন করা হলে জবাব পাওয়া যায়, ‘নারে ভাই, হাতে কোনো কাজ নেই, এখানে এসেছিলাম গল্প করে সময় কাটানোর জন্য, এই আর কী? অনেকের প্রশ্ন এফডিসি হলো কেপিআইভুক্ত এলাকা। কেপিআইভুক্ত এলাকায় কী করে মিটিং, মিছিল, তর্কবিতর্ক চলতে পারে। সরকার এ ক্ষেত্রে নীরব কেন? সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এফডিসিতে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর আলাপ-আলোচনা করা যায়। কোনো নীতিবিরুদ্ধ কাজ নয়। কিন্তু সেখানে চলতে থাকা নির্বাচন, মামলা, মিছিল, বয়কট, মিটিংসহ নানা কাজ চললেও সরকারের সংশ্ল্ষ্টি মন্ত্রণালয় তা দেখেও না দেখার ভান করে আসছে। সিনিয়র চলচ্চিত্রকার সুচন্দা আক্ষেপ করে বলেন, এফডিসি হলো চলচ্চিত্র নির্মাণের স্থান। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সেবা পাওয়ার জায়গা। তাছাড়া সৃষ্টিশীল মানুষের বিচরণভূমি হচ্ছে চলচ্চিত্র জগৎ। চলচ্চিত্রকার ও তাঁদের সৃষ্টি দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ দেশীয় কৃষ্টি-কালচার, সমাজ, পরিবার সম্পর্কে জানবে, জ্ঞান আহরণ করবে আর দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা প্রদর্শন করবে। কিন্তু এখন হচ্ছে এর বিপরীত। এই জগৎ হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের লীলাভূমি। এখানে কেন দলাদলি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, কাদা ছোড়াছুড়ির মতো ঘটনা ঘটবে। আমি বলব এখনো সময় আছে দেশের এই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটিকে পুনরায় শ্রদ্ধা ও সৃষ্টির আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সবাই দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসুন। নন্দিত চলচ্চিত্রকার  সোহেল রানা বরাবরই ক্ষোভ জানিয়ে বলে আসছেন, দীর্ঘদিন আগেই নানা কারণে আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ কোমায় চলে গেছে। তাই এই জগৎকে নিয়ে এখন হাহাকার করা ছাড়া আর কিছু নেই। কারণ সবাই ব্যস্ত নিজেদের স্বার্থ হাসিলে। চলচ্চিত্র জগৎকে বাঁচিয়ে তুলতে কারও কোনো মাথাব্যথা দেখি না। বর্তমান সরকার কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই চলচ্চিত্র জগৎকে সমুন্নত রাখতে সহযোগিতার কোনো কমতি রাখছে না। এরপরও যদি আমাদের চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে বোধ তৈরি না হয় তাহলে তো বলার আর কিছু নেই। চলচ্চিত্র প্রদর্শক, প্রযোজক ও মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার নওশাদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ছবি নেই, ছবির অভাবে দেশে এখন সিনেমা হলও শূন্যের কোঠায়। এমন পরিস্থিতিতে যদি সবাই এ জগতের উন্নয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে নেতৃত্ব আর স্বার্থ নিয়ে দলাদলিতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে আর কী করা। ছবির অভাবে আমার মধুমিতা ও দেশের অবশিষ্ট সিনেমা হলগুলোও বন্ধের পথে। কারণ ছবি ছাড়া লোকসান গুণে কতদিন সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা যায়? আমার সিনেমা হলটির কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হয় এই হলটি চালু রাখতে সপ্তাহে ব্যয় আছে প্রায় ৬০ হাজার টাকারও বেশি, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত ছবির অভাবে সপ্তাহে আয় হয় বড়জোর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আমি বলব কেউ যদি একটি স্কুলের হেডমাস্টারের চেয়ারে বসে থাকেন কিন্তু তাঁর স্কুলে যদি কোনো ছাত্রই না থাকে তাহলে সেই হেডমাস্টার বা তাঁর চেয়ারের মূল্য কী? খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম। চলচ্চিত্র দেশ, সমাজ ও পরিবার বিনির্মাণে প্রচুর ভূমিকা রাখে। চলচ্চিত্র না থাকলে সচেতনতা সৃষ্টির অভাবে দেশ, সমাজ ও পরিবারের অনেক ক্ষতি হবে। আবার বলতে পারি চলচ্চিত্র হচ্ছে আবেগ তৈরির কারখানা। চলচ্চিত্র দেখে দর্শক ভালো কিছু শিখতে পারে। তাই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত সবারই এ শিল্পের মানমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে দৃষ্টি দেওয়াটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ বিষয়টিকে অবহেলা করে যারা নানা বিতর্কিত কাজের মাধ্যমে শিল্পটিকে কলুষিত করছে বা যাদের দ্বারা কলুষিত হচ্ছে তাদের কোনোভাবেই এই অঙ্গনে মেনে নেওয়া যায় না। এদের চলচ্চিত্রের মানমর্যাদা রক্ষায় নিজেকে সংযত রেখে বুঝেশুনে চলা উচিত। কারণ চলচ্চিত্রের প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি থাকে। তাই কারও কোনো নেতিবাচক কর্মকান্ড মেনে নেওয়া যায় না। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি শোয়েব রশীদ আক্ষেপ করে বলেন, শিল্পী বা অন্য কেউ চলচ্চিত্রের মানমর্যাদার দিকে লক্ষ্য না রেখে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে শিল্পটির মুখে কালিমা লেপন করছে ও দুর্নাম ছড়াচ্ছে তারা কখনই এই শিল্পে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্বের জন্য অবশ্যই হুমকিস্বরূপ। প্রকৃত চলচ্চিত্রকাররা কখনো তাঁদের মেনে নিতে পারে না। মানুষের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্র যেন অনন্য উচ্চতায় থাকে সেই ব্যবস্থা করাও সিনিয়র চলচ্চিত্রকারদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

সর্বশেষ খবর