শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

সেকালের ছবির গান একালের নাটক সিনেমা বিজ্ঞাপনে

আলী আফতাব

সেকালের ছবির গান একালের নাটক সিনেমা বিজ্ঞাপনে

‘আমার গরুর গাড়িতে’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘প্রেম বলে কিছু নেই’- এমন অসংখ্য গান আছে এখনো মানুষের মুখে মুখে। কারণ পুরনো দিনের গানের আবেদন সব সময় থেকে যায়। এসব গানের সুর-মূর্ছনা অনুরণন ছুঁয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সিনেমার গান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সময়ের পালাবদলে সংগীতায়োজনেও এসেছে নতুনত্ব। যে জন্য পুরনো গান নতুন সংগীতায়োজনে শ্রোতার কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই সময়ের নতুন শিল্পীরা। মূল গানের সঙ্গে নতুন সংগীতের মিশ্রণ অর্থাৎ রিমিক্স করা হচ্ছে, নয়তো নতুন রেকর্ডে রিমেক করা হচ্ছে জনপ্রিয় সব সিনেমার গান। বিশ্বজুড়ে এটি শুরু হয়েছিল আশির দশকের শেষ প্রান্তে। নব্বইয়ের দশকে তা জোয়ার বয়ে এনেছিল বিশ্বের নানা দেশে। এ দেশেও সিনেমার গানের রিমিক্স ও রিমেক করা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে ‘বায়োস্কোপ’ নামের মিশ্র অ্যালবাম দিয়ে এর সূচনা। 

‘আমার গরুর গাড়িতে’, ‘চঞ্চলা মেঘ’, ‘সাগরের তীর থেকে’সহ এই অ্যালবামের প্রতিটি রিমিক্স গান শ্রোতার মাঝে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় পরে ‘বায়োস্কোপ-২’ নামে আরেকটি অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়। এর পরপরই মূলত জোয়ার শুরু হয় রিমিক্স ও রিমেক গানের অ্যালবাম প্রকাশের। ‘সিনেমা’, ‘সিনেমা-২’, ‘চুমকি চলেছে একা’, ‘চুমকি-২’, ‘মিস লংকা’, ‘বাঁশিওয়ালা’সহ শতাধিক অ্যালবাম প্রকাশ করা হয় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। ক্যাসেট-সিডির যুগে শুধু অ্যালবাম নয়; বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এমনকি নাটকেও সিনেমার গানের রিমেক করতে দেখা গেছে। গানের মূল শিল্পীদের অনেকে বিষয়টা মেনে নিতে না পারায় পরবর্তীকালে নিজেরাই তাদের জনপ্রিয় গানগুলো রিমেক করেছেন। এর মধ্যে আবদুল জব্বারের ‘ওরে নীল দরিয়া’, সৈয়দ আবদুল হাদীর ‘একবার যদি কেউ’, এন্ড্রু কিশোরের ‘ফিরে ফিরে আসি’, ‘আবার ফিরে এলাম’, সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, সুবীর নন্দীর ‘প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, শাম্মী আখতারের ‘ঢাকার শহর আইসা’, খুরশীদ আলমের ‘চুরি করেছ আমার মনটা’সহ বেশ কিছু রিমেক অ্যালবাম শ্রোতার কাছে নতুন করে আলোড়ন তুলেছিল। তারপরও তরুণ শিল্পী ও সংগীতায়োজকরা থেমে থাকেননি। একের পর এক রিমেক গানের আয়োজন ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে।

সাম্প্রতিক সময় রিমেক গান একক ও দ্বৈত কণ্ঠে রেকর্ড করে ভিডিও হিসেবে প্রকাশ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি নাটক, সিনেমায়ও পুরনো গানের রিমেক করা হচ্ছে। সিনেমার গানের বেশ কিছু রিমেকে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন শিল্পী ইমরান। তাঁর গাওয়া ও নতুন সংগীতায়োজনের ‘তুমি আমার জীবন’, ‘হৃদয়ের আয়না’, ‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’, ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, ‘অনেক সাধনার পরে’, ‘পৃথিবীতে সুখ বলে যদি’সহ অন্যান্য গান শ্রোতাদের মনে ছাপ ফেলেছে। একইভাবে তরুণ দুই শিল্পী হাসান এস ইকবাল ও দৃষ্টি আনামের গাওয়া বাংলা সিনেমার বেশ কিছু রিমেক গান শ্রোতার মাঝে সাড়া ফেলেছে। সম্প্রতি নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি সিনেমার বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের রিমেকে কণ্ঠ দিয়েছেন। শুধু একক গান হিসেবে প্রকাশ নয়; সিনেমায়ও রিমেক গানের ব্যবহার চোখে পড়ছে। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবির ‘তুমি আমার জীবন’ জনপ্রিয় গানটি রিমেক করা হয়েছে ‘বীর’-এর জন্য। ১৯৯৯ সালের ‘ভালোবাসি তোমাকে’ ছবির ‘অনেক সাধনার পরে’ গানের রিমেক রাখা হয়েছে ‘নিয়তি’ ছবিতে।

অন্যদিকে ‘গ্যাংস্টার’ ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে ‘হৃদয়ের আয়না’ ছবির জনপ্রিয় গানের রিমেক। নাটকেও এ বিষয়টি থেমে থাকেনি। এর মধ্যে ‘শিল্পী’ নাটকের জন্য রিমেক করা ‘বাস্তব’ ছবির ‘বুক চিন চিন করছে’ গানটি রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে। এমন আরও গান আছে যেগুলো রিমিক্স বা রিমেক করে নাটক, সিনেমায় রাখা হয়েছে। এতে গানের মূল শিল্পী ও স্রষ্টারা বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুললেও রিমেক থেমে থাকেনি।

তারপরও যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো, সিনেমার গানের মূল শিল্পী ও সুরকারদের অনুমতি না নিয়ে একের পর এক গান রিমেক করা। অনেক শিল্পী ও সুরকার দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁদের গান অনেকে রিমেক করছেন। কিন্তু তাঁরা গানের মূল শিল্পী, গীতিকার, সুরকারদের অনুমতি নিচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ গানের মূল স্রষ্টাদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। কেউ ভালো লাগা থেকে কোনো গান গাইলে তা নিয়ে শিল্পী বা সংগীত স্রষ্টাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যখন তা বাণিজ্যিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, তখন এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার। এ প্রসঙ্গে খুরশীদ আলম বলেন, একটা গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য রাত পার করে দিতাম। যতক্ষণ গানটি সবার পছন্দ না হতো সেই সময় পর্যন্ত রেকর্ড হতো। যন্ত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক সবার মধ্যে তখন সুন্দর একটি সমন্বয় ছিল। গানটি করার আগে গীতিকার ও সুরকার বসতেন। সংগীতের সোনালী সময়ের যতগুলো গান জনপ্রিয় হয়েছে সবকটির  পেছনে আছে এক একটি গল্প। গীতিকার-সুরকার একসঙ্গে না বসলে ভালো গান হয় না। একটি গান রের্কড শেষ করে যাওয়ার পর আবার খবর নিতাম কোথাও ভুল আছে কি না। তবে আমরা কেউ ধৈর্য হারাতাম না। আমাদের সবার লক্ষ্য থাকত একটি ভালো গান তৈরি করা। সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো আমাদের সময়ে গানে অ্যাকুস্টিক যন্ত্রের ব্যবহার থাকত সব সময়।  আর এ কারণে গানের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু এই সুন্দর গানগুলো যখন আমাদের না জানিয়ে রিমেক করে নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়, তখন অনেক কষ্ট হয়।

সর্বশেষ খবর