শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

যাত্রাশিল্পের পুনরুদ্ধারে শিল্পকলার উদ্যোগ

মোস্তফা মতিহার

যাত্রাশিল্পের পুনরুদ্ধারে শিল্পকলার উদ্যোগ

আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্য যাত্রাপালা। শিল্পীদের নাচ-গান, অভিনয়শিল্পীদের ভরাট কণ্ঠের উচ্চ আওয়াজের কাঁপা কাঁপা সংলাপ আর বিবেকের করুণ সুরে দর্শক-শ্রোতারা বিগলিত হতো, আবেগাপ্লুত হতো আবার কখনো উদ্দামতা আর উষ্ণতায় আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির এই ধারা অভিনন্দনের বৃষ্টিতে ভাসত। আপন দুলাল, রহিম-রূপবান, দেওয়ানা মদিনা, আলাল-দুলাল, সাগরভাসা, গুনাইবিবির মতো মনমাতানো সব যাত্রাপালা দেখার জন্য এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা বিনিদ্র রজনী কাটালেও সেসব এখন কল্পলোকের গল্পের মতোই। রাতভর যাত্রা দেখে ভোরবেলায় বাড়ি ফেরার ভালো লাগার সেই দৃশ্য এখন রূপকথার রাজ্যের ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মতো। কালের বিবর্তনে গর্ব করার মতো বাঙালির নিজস্ব এই সংস্কৃতি বর্তমানে মরতে মরতে খুব করুণ ও অসহায়ভাবে বেঁচে আছে। বলা চলে, যাত্রা এখন সংস্কৃতির আইসিইউতে রয়েছে। মৃতপ্রায় এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। বাঙালির নিজস্ব এই সংস্কৃতিকে রক্ষা করে এটিকে নতুন করে চাঙা করার প্রত্যয়ে সারা দেশে ৯৯টি যাত্রাপালা মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি। যার বেশির ভাগ ইতোমধ্যেই মঞ্চায়ন হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে চলমান এই কার্যক্রমে নিবন্ধিত ৮২টি যাত্রাদল, ১০ জন নির্দেশক এবং সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একাডেমির এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে এরমধ্যে দেশব্যাপী নতুন যাত্রাপালা নির্মাণে যথাক্রমে ৫০ হাজার, ২ লাখ এবং আড়াই লাখ টাকা করে ছাড় প্রদান করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জেলায় মঞ্চায়ন হয়েছে। অন্যদিকে, মুজিববর্ষ ও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে লালপুর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দি জীবন নিয়ে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি ‘নিঃসঙ্গ লড়াই’ নামের একটি যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করে অনন্য রেকর্ড স্থাপন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। দেশের যাত্রাদলগুলোকে নিবন্ধনের লক্ষ্যে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছিল একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ওই উৎসবে দেশের প্রায় ৪০টি যাত্রাদল অংশগ্রহণ করে। আর উৎসবের মাধ্যমে নিবন্ধনকৃত দলগুলোর অংশগ্রহণে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়। যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০১২ এর আলোকে নিবন্ধনের মাধ্যমে এর আগে ১৩০টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন সনদও প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘যাত্রাশিল্পের নবযাত্রা’ স্লোগানে যাত্রা-নীতিমালা প্রণয়ন করে কয়েক বছর ধরে যাত্রাদল নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান রেখেছে শিল্পকলা একাডেমি। ওই কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ১০৬টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। আর নিবন্ধনের লক্ষ্যে গত বছরের ১২ ও ১৩ নভেম্বর দশম যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়। দুই দিনের ওই উৎসবে প্রত্নযাত্রা ‘ঈসা খাঁ’ এবং মুনীর চৌধুরী রচিত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটককে যাত্রাপালায় রূপান্তর করে মঞ্চায়ন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় সারা দেশের ৬৪টি জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অধিভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। এদিকে, যাত্রার উন্নয়ন ও পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১০০টি দেশীয় যাত্রাপালা ও শতাধিক ভারতীয় যাত্রাপালা সংগ্রহ, ১০০টি দেশীয় যাত্রাপালা ১৯ জন বিশিষ্ট গবেষক/লেখক দ্বারা মূল্যায়ন, যাত্রা পালাকারদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন, কর্মশালাভিত্তিক পাঁচটি যাত্রা প্রযোজনা নির্মাণ ও প্রদর্শনী, সারা দেশ থেকে নিবন্ধিত যাত্রা দলগুলোর স্বত্বাধিকারী, ম্যানেজার, অভিনয়শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজনও করেছিল কর্তৃপক্ষ।

যাত্রাশিল্পকে রক্ষায় একাডেমির পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সম্প্রতি ১০০টি যাত্রাপালা নিয়ে সারা দেশে ১৯ দিনের যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছে একাডেমি কর্তৃপক্ষ। স্বাধীনতার মাস গত ১২ মার্চ শুরু হয়ে ৩০ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রাপালা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে শেষ হয় যাত্রাপালা নিয়ে ১৯ দিনের এই মহোৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে যাত্রার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান বাংলার শিকড়ের সংস্কৃতি হিসেবে যাত্রাশিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে। উৎসবের এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে যাত্রাশিল্প খুব শিগগিরই তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন যাত্রাশিল্পীরা। যাত্রাব্যক্তিত্ব মিলন কান্তি দে বলেন, ‘আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির ভাইরাসের কারণেই যাত্রা তার ঐতিহ্য ও সম্মান থেকে বিচ্যুত হয়। প্রাণের যাত্রাশিল্প রক্ষায় আমরা যখন চরম হতাশার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিলাম তখন শিল্পকলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। যাত্রাশিল্পকে রক্ষায় লিয়াকত আলী লাকী আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন বলে আমরা সারা দেশের যাত্রাশিল্পীরা তাঁর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। শিল্প-সংস্কৃতি ঋদ্ধ, সৃজনশীল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যাত্রাশিল্পের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার হোক।’

 

সর্বশেষ খবর