বুধবার, ১১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

সিনেমা হলের অভাবে অডিটোরিয়ামে ছবি প্রদর্শন : বাধা কেন ?

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা হলের অভাবে অডিটোরিয়ামে ছবি প্রদর্শন : বাধা কেন ?

জামালপুরের ইসলামপুরে ফরিদুল হক খান দুলাল অডিটোরিয়ামে দর্শকপূর্ণ ‘গলুই’ ছবির প্রদর্শন

ঈদে সিনেমা হলে দেখা গেল আশা-জাগানিয়া চিত্র। দীর্ঘদিন পরে মনেরমতো ছবি পেয়ে দর্শক ঢল নেমেছে প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু বিধিবাম, দেশের সব জায়গার দর্শক ঈদের ছবি দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ কমপক্ষে ২৯টি জেলায় কোনো সিনেমা হলই নেই। এতে শুধু দর্শকই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিগ বাজেটের ছবি মুক্তি দিয়ে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন। কারণ ছবি প্রদর্শনের জায়গা না থাকলে লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত আসবে কীভাবে।

তাই সরকারি অনুদানে নির্মিত খোরশেদ আলম খসরু প্রযোজিত ও এস এ হক অলিক পরিচালিত ‘গলুই’ ছবিটি দর্শকের বিপুল চাহিদার কারণে যেসব স্থানে সিনেমা হল নেই সেখানে বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে দর্শকের খুশির সীমা ছিল না। তাদের ঢল নামে সব জায়গায়। টিকিট না পেয়ে আগামী দিনের অগ্রিম টিকিট কিনতেও পিছপা হয়নি তারা। চলচ্চিত্রের দুর্দিনে এমন আশার চিত্রে শেষ পর্যন্ত নির্দয়ভাবে পানি ঢেলে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আইনের দোহাই দিয়ে অডিটোরিয়ামে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়ে নির্মাতাকে বসিয়েছে পথে আর দর্শকদের করেছে চরম হতাশ। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘১৯১৮ সালের একটি আইনে আছে যেসব স্থানে সিনেমা হল আছে সেখানকার কোনো অডিটোরিয়াম বা কোনো স্থানে টাকার বিনিময়ে ছবি প্রদর্শন করা যাবে না। কিন্তু জামালপুরের যেসব স্থানে  ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছিল সেখানে তো কোনো সিনেমা হল নেই। তাহলে এ ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন কীভাবে হলো? যদি বন্ধই করতেই হতো তাহলে ঈদের দিন থেকে কীভাবে এখানে ছবি প্রদর্শন করতে দেওয়া হলো। দেশীয় চলচ্চিত্রে যখন চরম খরা চলছে তখন এই ঈদে সিনেমা হলে বিপুলভাবে দর্শক ফিরে আসাটা সত্যিই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি আশা-জাগানিয়া দিক। এই অবস্থা বিবেচনা করে হলেও দেশীয় চলচ্চিত্রের ফের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বার্থে প্রশাসনকে এক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া উচিত ছিল। এভাবে প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হয়নি।’ ঈদের দিন অর্থাৎ ৩ মে  জামালপুরের বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে ‘গলুই’ ছবিটি চললেও ৯ মে প্রদর্শন বন্ধ করে দেন জামালপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুর্শেদা জামান। প্রযোজক-পরিচালকের সামনে তুলে ধরেন ১৯১৮ সালের দ্য সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট। জানান, আইনে নেই, তাই সিনেমা হলের বাইরে ছবিটির বাণিজ্যিক প্রদর্শন করা যাবে না। এতে প্রতিবাদ ওঠে চলচ্চিত্র অঙ্গনে। বলা হয়, স্বাধীন দেশের ৫০ বছর পেরিয়েও ব্রিটিশ আমলের আইনে আটকে গেল একটি দেশাত্মবোধের সিনেমা প্রদর্শন। ঠিক কী কারণে এমনটা ঘটল, এ বিষয়ে জামালপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুর্শেদা জামান জানান, অডিটোরায়ামগুলো তো আর সিনেমার হল নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এর প্রদর্শনের অনুমতি ছিল। অনুমতির সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য আরও এক দিন প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোখলেছর রহমান বলেন, ‘সিনেমাটি প্রদর্শনীর জন্য নতুন করে আমাদের কাছে কেউ আবেদন করেনি। তাছাড়া এসব (বাণিজ্যিক) সিনেমা লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রেক্ষাগৃহেই চলার কথা। এখানে আইনের কোনো বিষয় নেই। সব অডিটোরিয়াম নিয়মনীতি মেনে চালানো হয়। অডিটোরিয়াম তো সিনেমা প্রদর্শনীর স্থান নয়। কোনো অডিটোরিয়ামে সিনেমার প্রদর্শনী-এটা হতে পারে না।’ এর আগে ২৯ এপ্রিল আবেদন করে সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য এক সপ্তাহের অনুমতি পান ‘গলুই’ সংশ্লিষ্টরা। ঈদের দিন থেকে জেলা পরিষদের কাছ থেকে সাত দিনের অনুমতি নিয়ে জামালপুর শিল্পকলা একাডেমির নতুন অডিটোরিয়াম, জামালপুরের মাদারগঞ্জে নুরুন্নাহার মাল্টিপারপাস অডিটোরিয়াম, ইসলামপুরের ফরিদুল হক খান দুলাল অডিটোরিয়াম ও জামালপুর মির্জা আজম অডিটোরিয়ামে এ সিনেমার প্রদর্শন চলে আসছিল।

৯ মে ছিল প্রদর্শনীর অনুমোদনের শেষ দিন। এরপর আর অনুমোদন বাড়ানো হচ্ছে না দাবি করেছেন ‘গলুই’ সিনেমার পরিচালক এস এ হক অলিক। অলিক বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে প্রথমে শিল্পকলা একাডেমি, পরে মির্জা আজম অডিটোরিয়াম, মাদারগঞ্জ ও ইসলামপুরে সিনেমাটি প্রদর্শন করে আসছিলাম। ঈদের দিন থেকেই দর্শকের উপচে পড়া ভিড় ছিল। জামালপুর ও মাদারগঞ্জে সিনেমার প্রদর্শনী চলছিল, কিন্তু ইসলামপুরে ঈদের পরের দিন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন সিনেমার প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়। আবারও আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিনেমা প্রদর্শনের জন্য কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আমাদের বলা হয়, ১৯১৮ সালের আইনের আওতায় আর অনুমোদন দেওয়া হবে না।’ তিনি আরও জানান, ‘ওই আইনে আছে সিনেমা হল ব্যতীত অন্য কোথাও বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা প্রদর্শন করা যাবে না। জামালপুরে একমাত্র মেলান্দহ ছাড়া আর কোথাও কোনো সিনেমা হল নেই। সিনেমাটি দেখানোর বিকল্প পথ হিসেবে আমরা অডিটোরিয়ামগুলো বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু আইনের দোহাই দিয়ে সেই পথটাও বন্ধ করে দিলেন জেলা প্রশাসক। হঠাৎ এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো ষড়যন্ত্র হলেও হতে পারে।’ নির্মাতা এস এ হক অলিক বেদনা কাতরভাবে আরও বলেন, ‘যেহেতু জামালপুরে কোনো সিনেমা হল নেই, তাই আমরা সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য প্রথমে শিল্পকলা একাডেমির অডিটোরিয়াম বেছে নিয়েছিলাম। একাডেমির দায়িত্বে থাকা ও সেখানকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়েই ছবিটি চালানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু চাঁদরাতে সেখানকার ডিসি সিনেমা প্রদর্শনীতে বাধা দেন। পরে আমরা শহরের মির্জা আজম অডিটোরিয়ামে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করি। এটা স্থানীয় অডিটোরিয়াম। এ বিষয়ে ডিসির সঙ্গেও কথা বলি। ছবিটি চালানোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি তা শোনেননি। ৫ তারিখে এসে তিনি পুনরায় ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করে দেন।’ নির্মাতা আরও বলেন, ‘১৯১৮ সালের একটি আইন আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন ডিসি। সেই আইন বলেই শো বন্ধ করে দেওয়ার হুকুম দেন তিনি। কোনো উপায় না পেয়ে, গত দুই দিনে যারা অগ্রিম টিকিট কিনেছেন সেটা দর্শকদের ফিরিয়ে দিয়েছি।’

এদিকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আইনের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা আছে আমাদের সবার। তবে এ ধরনের পুরনো আইন বর্তমান সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির জন্য কতটা অনুকূল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ তা ভেবে দেখে এমন প্রাচীন আইনকে সংশোধন করে সময় উপযোগী করতে হবে সরকারকে। না হলে নানাভাবে দেশের মানুষ হয়রানির মুখে পড়বে। যেভাবে এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ‘গলুই’ ছবির নির্মাতা। একই সঙ্গে দর্শকরাও ছবিটি দেখা থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশ হচ্ছে। এর বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভগ্নদশায় জর্জরিত আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর। আমি বলব শুধু এটি নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন সব আইন সংশোধন করা জরুরি। ‘গলুই’ ছবির ব্যাপারে আমি প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব যেহেতু ওই অঞ্চলে কোনো সিনেমা হল নেই এবং শুরুতে অডিটোরিয়ামে ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাই সেই অনুমতির সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়ে নির্মাতাকে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো হোক, দর্শক আগ্রহ পূরণ করা হোক সর্বোপরি দেশীয় চলচ্চিত্রকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা হোক। ছবিটির প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, দেশে যদি সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থাই না থাকে তা হলে কেন আর ছবি নির্মাণ করব। এটি ছিল সরকারি অনুদান পাওয়া প্রথম কোনো ছবি যা উৎসবে বড় আকারে সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ছবিটি দর্শক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ছবিটি নির্মাণে সরকারি যে অনুদান পাওয়া গেছে তা এমন একটি বিগ অ্যারেঞ্জমেন্টের ছবি নির্মাণে যথেষ্ট ছিল না বলে এর সঙ্গে বাড়তি অর্থ যোগ করে বিগ বাজেটের এই ছবিটি নির্মাণ করেছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে সিনেমা হল না থাকায় সেসব স্থানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই অডিটোরিয়ামে ছবিটি প্রদর্শন করছিলাম। কিন্তু ছবিটি চলার মাঝপথে এসে এভাবে আইনের দোহাই দিয়ে এর প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া মানে নির্মাতাকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে পথে বসিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন, দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। না হলে আমরা ছবি কীভাবে নির্মাণ করব আর কোথায় প্রদর্শন করব। এদিকে এফডিসিসহ চলচ্চিত্র পাড়ায় চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের ক্ষোভ ঝরা প্রশ্ন হলো এর আগে একাধিকবার দেশের বিভিন্ন স্থানে অডিটোরিয়ামসহ বিভিন্ন মিলনায়তনে বিকল্প ধারার অনেক ছবি দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়েছে এবং সেখানে সিনেমা হল থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন ওইসব ছবি অডিটোরিয়ামে প্রদর্শনের অনুমতি দিয়েছে। তাহলে এখন ‘গলুই’ ছবিটি অডিটোরিয়ামে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যে আইনের কথা বলা হচ্ছে ওইসব ছবি প্রদর্শনের সময় সেই আইন তখন কোথায় ছিল?

সর্বশেষ খবর