রবিবার, ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্ত হচ্ছে আটকে থাকা যত ছবি

ঈদের ছবির সাফল্যে উৎসাহিত নির্মাতারা

আলাউদ্দীন মাজিদ

মুক্ত হচ্ছে আটকে থাকা যত ছবি

শাকিব-দর্শনা

চলচ্চিত্র জগতে দীর্ঘদিন চলছিল চরম খরা। এবারের ঈদ সেই খরায় স্বস্তির বৃষ্টি এনে দিয়েছে। ঈদের ছবি দেখতে সিনেমা হলবিমুখ দর্শকরা মহাসমারোহে সিনেমা হলে ফিরেছে। ঈদে মুক্তি পাওয়া তিনটি ছবি ‘গলুই’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’ মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেও কাক্সিক্ষত ব্যবসা করে যাচ্ছে। এই চিত্র দেখে উৎসাহিত হয়েছেন গত কয়েক বছরে আটকে থাকা প্রায় অর্ধশত ছবির নির্মাতারা। তাঁরা এবার কখন তাঁদের ছবি মুক্তি দেবেন সেই হিসাব কষছেন। ঈদের দিন থেকে সিনেমা হলের সামনে টিকিটের জন্য দীর্ঘ লাইন। দেশের সব সিনেমা হলেই প্রতিটি শো প্রায় হাউসফুল। এমন খবর দিয়েছেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল। এই কর্মকর্তা বলেন, নব্বই দশকের শেষদিক থেকে অশ্লীলতা, পাইরেসি, মানসম্মত ছবির অভাব ও নকল ছবির কারণে দর্শক সিনেমা হলবিমুখ হয়ে পড়ে। এতে ব্যবসায়িক লোকসান গুনতে গুনতে সিনেমা হল মালিকদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন থেকেই সিনেমা হল বন্ধ করা শুরু হয়। নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত দেশে থাকা প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ সিনেমা হল বন্ধের কবলে পড়ে। এখন আছে মাত্র অর্ধশতাধিকের মতো। সিনেমা হল মালিকদের একটিই দাবি ছিল মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবি চাই। না হলে সিনেমা হল বন্ধ রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর জন্য হল মালিকরা বিদেশি ছবিও নিয়মিত আমদানির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এসব দাবির কোনোটিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় সিনেমা হলের সংখ্যা এখন বলতে গেলে একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। মাঝে মধ্যে দু-একটি ভালো মানের ছবি পেলেও তা দিয়ে একটি সিনেমা হলের সারা বছরের খরচ তো আর তুলে আনা যায় না। তবে এবারের ঈদে সুখের বিষয় হলো তিনটি ছবিই দর্শক দেখছে। উজ্জ্বল নির্মাতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘প্লিজ আপনারা নিয়মিত পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি দিন, তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পের এই বন্ধ্যত্ব কাটতে বাধ্য। এদিকে জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিইও আলীমউল্লাহ খোকন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান ২০১২ সাল থেকে নিয়মিত মানসম্মত ছবি উপহার দিয়ে দেশের চলচ্চিত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু ২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারি করোনা শুরু হলে চলচ্চিত্র মুক্তি আটকে যায়। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।  ফলে গত দুই বছর ধরে আমাদেরসহ মুক্তি আটকা পড়ে প্রায় অর্ধশত ছবি। ঈদে মুক্তি পাওয়া আমাদের প্রতিষ্ঠানের ‘শান’ ছবিটি ২০২০ সাল থেকে করোনার কারণে আটকে পড়া ছিল। কয়েকবার মুক্তির উদ্যোগ নিলেও করোনার কারণে  সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সর্বশেষ দীর্ঘ সময় পর এই ঈদে ব্যবসায়িক শঙ্কার মধ্যে মুক্তি দিয়ে ভালো ব্যবসা করায় এখন আমাদের আটকে পড়া অন্য ছবিগুলোও মুক্তি দিতে সাহস পাচ্ছি।

উল্লেখ্য, করোনার ভয়াবহতায় চলচ্চিত্র শিল্প বলতে গেলে চলে গেছে কোমায়। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় সাত মাস করোনার কারণে সিনেমা হল ও চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ থাকে। ১৬ অক্টোবর সিনেমা হল খুললেও বেশির ভাগ প্রযোজক ছবি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তাঁদের কথায় করোনার ভয়ে সিনেমা হলে দর্শক কতটা আসবে তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। তার ওপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিনেমা হলের অর্ধেক আসন খালি রাখতে গিয়ে চলচ্চিত্রে লগ্নিকৃত অর্থ কতটা ফেরত আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে সরকার আবার করোনা সতর্কতার লকডাউন জারি করলেও এ সম্পর্কিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে সিনেমা হল বন্ধের কথা উল্লেখ ছিল না। তাই ওই বছরের রমজানের ঈদে ‘সৌভাগ্য’ শিরোনামে একটি নতুন ছবি মুক্তি দিলেও স্থানীয় জেলা প্রশাসন ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ স্থানে করোনার কারণে সিনেমা হল খুলতে বাধা দেয় এবং ‘সৌভাগ্য’ ছবিটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এতে অন্য প্রযোজকরা নতুন ছবি মুক্তি দিতে লোকসানের ভয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দেশ-বিদেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হলে প্রযোজকরা আবার ছবি মুক্তি দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথমেই দীপংকর দীপন তাঁর ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবিটি ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। অনন্ত জলিল ২৪ ডিসেম্বর তাঁর ‘দিন : দ্য ডে’ ছবিটির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেন। সোহানী হোসেন প্রযোজিত ও সুমন ওয়াজেদ পরিচালিত শাকিব খান ও দর্শনা অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’ ছবিটির মুক্তির তারিখও ঘোষণার প্রস্তুতি চলছিল। মোস্তাফিজুর রহমান মানিক জানিয়েছিলেন, নতুন বছরই ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ ছবিটি মুক্তির তারিখ ঘোষণা করা হবে। নির্মাতা  সৈকত নাসিরসহ অন্য আটকে থাকা ছবিগুলোর নির্মাতারাও জানান, করোনা পরিস্থিতির আর অবনতি না হলে তাঁরা তাঁদের ছবিগুলো মুক্তি দেওয়া শুরু করবেন। এরপর ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘কমান্ডো’, ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’, ‘সাইকো’, ‘সাহসী যোদ্ধা’, ‘তালাশ’, আশরাফ শিশির পরিচালিত ‘৫৭০’, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘পাপ-পুণ্য’, মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’,  সৈকত নাসির পরিচালিত ‘ক্যাসিনো’, মাহমুদ দিদার পরিচালিত ‘বিউটি সার্কাস’, রায়হান রাফি পরিচালিত ‘দামাল’। এ ছাড়া ‘আদম’, ‘জ্যাম’, ‘গাঙচিল’, ‘বীরত্ব’, ‘ঢাকা-২০৪০’, ‘গিরগিটি’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের মুক্তি প্রায় দুই বছর ধরে আটকে যায় শুধু করোনার ভয়াবহতায়। ২০২০ সালে মুক্তির তালিকায় থাকা প্রায় অর্ধশত চলচ্চিত্রের মধ্যে আলোর মুখ দেখেছিল মাত্র ১৫টি। ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র। গত দুই বছরে স্বল্প বাজেটের কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেলেও বিগ বাজেটের তারকাবহুল ছবি বলতে গেলে মুক্তি পায়নি। ২০২০ সাল থেকে ছবির প্রধান মৌসুম দুই ঈদে ‘সৌভাগ্য’ ছাড়া আর কোনো নতুন ছবি মুক্তি পায়নি। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ছবি যদি নির্মাণ শেষে দীর্ঘদিন ধরে মুক্তি না পায় তা হলে আশপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও ঘটনা আবহ বদলে যাওয়ার কারণে সেই ছবি আর দর্শক দেখে না, কারণ এতে আর সমসাময়িক কোনো চিত্রই থাকে না। ফলে পড়ে থাকা ছবিটির ম্যারিট নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন ছবিটির নির্মাতা। গত দুই বছর ধরে করোনা মহামারি সেই ক্ষতিকে তীব্র করে তুলেছে। সবশেষ তথ্য হলো এবারের ঈদের ছবির সফলতা দেখে আবারও আশায় বুক বাঁধছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। তাঁরা তাঁদের আটকে থাকা ছবি মুক্তি দেবেন শিগগিরই- এমন উদ্যোগই এখন নিচ্ছেন। এ ছাড়া কোরবানির ঈদে মুক্তি দেওয়ার জন্যও নির্মাতারা তাঁদের আটকে পড়া ছবির নাম প্রকাশ করছেন। সর্বশেষ ঈদুল আজহায় মুক্তির জন্য ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে শাকিব খান অভিনীত ‘অন্তরাত্মা’, ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’, অনন্ত-বর্ষা অভিনীত ‘দিন : দ্য ডে’ এবং সিয়াম অভিনীত ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবিগুলোর নাম। চলচ্চিত্র বোদ্বাদের কথায় ‘নির্মাতারা যদি নিয়মিত এভাবে মানসম্মত ছবি নির্মাণ ও মুক্তি দিতে পারেন তাহলে দেশীয় চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরতে বেশি সময় লাগবে না।’

সর্বশেষ খবর