বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

অনন্তযাত্রায় কে কে

শোবিজ প্রতিবেদক

অনন্তযাত্রায় কে কে

কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ : জন্ম : ২৩ আগস্ট, ১৯৬৮ : মৃত্যু : ৩১ মে, ২০২২

হাতে মাইক্রোফোন, গান ধরেছিলেন ভারতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কে কে। কলকাতায় একটি কলেজের অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিলেন মঙ্গলবার।  অনুষ্ঠান শেষে ধর্মতলার একটি হোটেলে যাওয়ার পর অসুস্থ বোধ করেন। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় ৫৪ বছরের নেপথ্য এ গায়ককে। সুরের শহরেই শেষ গান গেয়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন গানের মানুষ কে কে। তাঁর চিরবিদায়ের কথা তুলে ধরা হলো-

 

নজরুল মঞ্চ ভিড়ে ঠাসা। দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা, কখন আসবেন গায়ক? কে কে এলেন। কণ্ঠে সুরের ঝাঁপি আর হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে। হাততালিতে ফেটে পড়ল হল। ‘হাম, রাহে ইয়া না রাহে কাল...’ , মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাইক্রোফোন হাতে গায়ক কে কে গেয়ে চলেছেন, উপলক্ষ কলকাতার গুরুদাস কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান শুরু হতেই উৎসাহ-উত্তেজনায় দর্শকদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার। হবে না-ই বা কেন, মঞ্চে যিনি গান গাইতে উঠেছেন, তিনি তো আর সাধারণ কেউ নন। বলিউডের তারকা নেপথ্য গায়ক কে কে। মঞ্চে ওঠে দর্শকদের মাতাতে পারা সংগীতশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম কে কে। মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়ার পাশাপাশি গাইতে থাকেন একের পর এক গান। বাড়তে থাকে দর্শকদের উত্তেজনাও। নজরুল মঞ্চে হাজির দর্শক-শ্রোতারা দেখলেন, ৫৪ বছর বয়সী একজন গায়ক কতটা তরতাজা। গান গাইতে গাইতে মঞ্চের এ পাশ থেকে অন্য পাশে দাপিয়ে বেড়াতেও দেখা গেল কে কে-কে। কখনো দর্শকদের উদ্দেশে ‘ফ্লাইং কিস’ ছুড়ে দিচ্ছেন তো কখনো আবার গাইতে গাইতে নিজের মনেই লাফাচ্ছেন। দর্শকদের অনেকেই কে কে-কে দেখার জন্য, তাঁর গান শোনার জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন। গান গাওয়ার ফাঁকে কে কে মঞ্চের স্পটলাইটগুলো নিভিয়ে দেওয়ার অনুরোধও করেন। স্পটলাইট নেভাতেই শতাধিক ফোনের ফ্লাশলাইটের ঝলকানি গানের পরিবেশে অন্য এক মাত্রা যোগ করে অনুষ্ঠানে। গান গাইতে গায়ককে দরদর করে ঘামতেও দেখা গেছে। মাঝে মাঝে সাদা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিয়েছেন। তবে চোখে-মুখে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। শেষের দিকে বেশ খানিকটা ক্লান্তই লাগছিল তাঁকে। ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল কি? কষ্ট হলেও বুঝতে দেননি। অনুষ্ঠানের শেষ অবধি দর্শকদের আবদার মিটিয়েছেন মুখের মিষ্টি হাসি ধরে রেখেই। নানারকমের আলোর ঝলকানি। মঞ্চে গাইছেন কে কে। গানের মাঝে বারবার রুমালে মুখ-কপালের ঘাম মুছছেন শিল্পী। মাথায়ও ওই রুমাল বোলাচ্ছেন। একাধিকবার ছোট বোতল থেকে গলায় ঢালছেন পানি। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কে কে ছিলেন অত্যন্ত চনমনে। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশ। কিন্তু বারবার চলে যাচ্ছিলেন মঞ্চের পেছনের অংশে নিচু টেবিলে রাখা রুমাল ও পানির বোতলের দিকে। মুখ-মাথা মুছে গলায় অল্প পানি ঢেলে ফের পরের গান। তারপর একজনকে হাতের ইশারায় মঞ্চের ওপরের আলোগুলো দেখিয়ে বললেন, নিভিয়ে দাও। ফের গান শুরু। নজরুল মঞ্চে উপস্থিত দর্শক তখন কে কের গানে মাতোয়ারা। অনুষ্ঠান শেষ হতেই চলে যান ধর্মতলার বিলাসবহুল হোটেলে। সেখানে পৌঁছে শারীরিক অবস্থার অবনতি। সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, মৃত্যু হয়েছে কে কের। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু। নিজে বুঝে থাকলেও শারীরিক অসুবিধার কথা বুঝতে দেননি দর্শকদের। জাদুকরের মতো সুরের জাদু দেখিয়েছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ‘আলবিদা’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’ সিনেমায় তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গান। সুরের শহরকে সে কথাই হয়তো জানাতে এসেছিলেন কে কে। আর এই অনুভবের শেষ সাক্ষী কলকাতা।

 

 

সংগীত জীবন

কে কে হিন্দিতে ৫০০টিরও বেশি গান এবং ২০০টিরও বেশি গান গেয়েছেন তেলেগু, বাংলা, তামিল, কান্নড় এবং মালায়ালাম ভাষায়। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রায় প্রতিটি সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালের সবচেয়ে বড় হিট গান টিউন মারি এন্ট্রিয়ানায় কণ্ঠ দিয়েছেন। বজরঙ্গি ভাইজানের ‘তু জো মিলা’ তাঁর প্লেব্যাক ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান।

 

এরকম গানের গলা ও প্রতিভা আর কারোরই নেই : ইমরান হাশমি

বলিউডের জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিঙ্গার হলেও কে কের গাওয়া সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইমরান হাশমির লিপে। বলা হয়ে থাকে এই অভিনেতা ও কণ্ঠশিল্পীর অদ্ভূত যুগলবন্দি জনপ্রিয় সব গানের জন্ম দিয়েছে। ইমরান হাশমির লিপে কে কের গাওয়া গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- সনিয়ে, তুহি মেরে সবহে, জারা সা দিল মে, বিতে লামহে, দিলনাসি, দিল এবাদত ইত্যাদি। আর সবার মতো কে কের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েছেন অভিনেতা ইমরান হাশমি নিজেও। এক আবেগঘন পোস্টে কণ্ঠশিল্পীর ভূয়সী প্রশংসা করে ইমরান হাশমি লেখেছেন, ‘এরকম গানের গলা ও প্রতিভা আর কারোর নেই। ঈশ্বর এমনটা বারবার তৈরি করেন না। তাঁর গাওয়া গানের সঙ্গে পারফরম করাটা সত্যিই বিশেষ কিছু। কে কে তুমি তোমার গাওয়া গানের মাধ্যমে কোটি ভক্তের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।’ 

 

উল্লেখযোগ্য গান

► আলবিদা [লাইফ ইন আ মেট্রো]

► দিল তরপ তরপ [হাম দিল দে চুক সানাম]

► বরদাশত না কর সাকতা [হুমরাজ]

► দশ বাহানে [দস]

► আঁখো মে তেরি [ওম শান্তি ওম]

► জারা সা দিল মে [জান্নাত]

► খুদা জানে [বাচনা এ হাসিনো]

► তু হি মেরি শব হ্যায় [ও লামহে]

► তু আশিকি হ্যায় [ঝাংকার বিটস]

► জিন্দেগি পাল পাল কি [ঘুড়ি]

► তু জো মিলা [বজরঙ্গি ভাইজান]

 

শোকে বিহ্বল

তাঁকে চিরকাল মনে রাখব : নরেন্দ্র মোদি

‘জনপ্রিয় গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কে কের অকাল মৃত্যুর খবরে মর্মাহত। সব প্রজন্মের শ্রোতাদের আবেগ-অনুভূতি ছুঁয়ে যেত তাঁর গান। শিল্পীর গানেই তাঁকে চিরকাল মনে রাখব আমরা। তাঁর পরিবার ও অনুরাগীদের সমবেদনা জানাই।’

গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি : মমতা ব্যানার্জি

বলিউড প্লেব্যাক গায়ক কে কের আকস্মিক ও অকাল মৃত্যুতে আমরা অবাক ও মর্মাহত। শিল্পীর পরিবারকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

 

মেনে নেওয়া কঠিন : শ্রেয়া ঘোষাল

এই খবরে আর মাথা ঠিক রাখতে পারছি না। অসাড়। এটা মেনে নেওয়া কঠিন! হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

এটা ঠিক হলো না : সনু নিগম

ভাই কে কে, এটা ঠিক হলো না। কে কে তোমাকে ছাড়া সব একই থাকবে না। কিছুই না। আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে  গেছে। বিশুদ্ধ কণ্ঠস্বর, শালীন, সত্যিকারের হৃদয়ের মানুষটা চলে গেল!

আমি হতবাক : প্রসেনজিৎ

শোকে বিহ্বল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, আমি হতবাক। অবিস্মরণীয় এক কণ্ঠ... কে কে আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবেন চিরকাল। তাঁর পরিবার, বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীদের সমবেদনা জানাই।

এত তাড়াতাড়ি কেন বন্ধু : এ আর রহমান

প্রিয় কে কে, এত তাড়াতাড়ি কেন বন্ধু! আপনার মতো প্রতিভাবান গায়ক এবং শিল্পীরা এই জীবনকে আরও সহনীয় করে তুলেছে।

শান্তিতে থেক : দেব

জানি না কী বলা উচিত : শান্তিতে থেক কেকে...

 

শিল্পের জন্য অনেক বড় ক্ষতি : অক্ষয়

কে কের দুঃখজনক প্রয়াণের খবরে আমি মর্মাহত। এটা শিল্পের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।

মানতে পারছি না : আরমান মালিক

এই মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের আরেকটি বড় ক্ষতি। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের কে কে স্যার আর নেই। আমি মানতে পারছি না।

অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল : কুমার শানু

তাঁর এত ভালো স্বাস্থ্য, শরীরচর্চা করত, এত সচেতন- তাঁর কি করে এমন হলো। এটা ভয়ানক খবর। এখনকার সবচেয়ে গুণী, সবচেয়ে সক্ষম গায়কদের একজন ছিল কে কে। যে কোনো ধরনের গানে সমান পারদর্শী। এত বৈচিত্র্য ছিল ওর গলায়। গানের জগতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর