শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকটের বেড়াজালে মঞ্চনাটক

সংকটের বেড়াজালে মঞ্চনাটক

প্রতিভা ও সাংগঠনিক সবলতা থাকা সত্ত্বেও ছোট দলগুলো ঠিকমতো মঞ্চ-মহড়াকক্ষ পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন প্রযোজনা মঞ্চস্থ না করতে পারার দরুন নাট্যকর্মীরা হতাশ হয়ে থিয়েটার চর্চা ছেড়ে দিচ্ছেন।

মঞ্চনাটক প্রদর্শনী নিয়ে নানা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দর্শক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য দরকার ভালো দেশীয় পা-ুলিপি, তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশক, মহড়াকক্ষ, মিলনায়তন, নতুন প্রযোজনা প্রভৃতি। অন্যদিকে রয়েছে মঞ্চে বড় দলের প্রভাব, হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা।  ঢাকার মঞ্চনাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন সংকট ও তার থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন- পান্থ আফজাল

 

মৌলিক পান্ডুলিপি সংকট

পান্ডুলিপি নাট্যচর্চার জন্য অন্যতম প্রধান একটি উপাদান। এ ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই আমাদের মঞ্চে বিদেশি নাট্যকারের নাটক অনুবাদ বা রূপান্তর করে পান্ডুলিপি করার একটা ধারা চলে এসেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বিদেশি নাটক দেশজ আদলে নিয়ে এলে সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতিকে কতটা প্রাধান্য দেওয়া হয় তা এখন দেখার বিষয়। সম্প্রতি সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক ও বিষয়-বৈচিত্র্যের কিছু পান্ডুলিপি আমাদের মঞ্চাঙ্গনকে উৎসাহিত করলেও এখনো দেশীয় মৌলিক পান্ডুলিপি সংকট রয়েই গেছে। এ বিষয়ে নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘সব মাধ্যমেই পান্ডুলিপি সংকট রয়েছে। তা টেলিভিশন নাটক, মঞ্চ বা অন্য যে কোনো মাধ্যম হোক না কেন। মঞ্চনাটক নিয়ে লেখার সংকট আছে। মঞ্চে সৃজনশীল লেখার অভাব রয়েছে।’

 

মহড়াকক্ষ সংকট

দেশের মঞ্চনাটকে মহড়াকক্ষের সংকট বহু পুরনো। এ সংকট যেন কাটছেই না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় নাট্যশালায় রয়েছে মাত্র চারটি মহড়াকক্ষ। সুতরাং কেউ নিয়মিত নাট্যচর্চা করতে পারছে না। অপেক্ষা করতে হয় মহড়াকক্ষ বরাদ্দ পাওয়ার। এই বরাদ্দ বেশির ভাগ সময়ই পায় বড় নাট্যদলগুলো। তাই অবহেলার শিকার হচ্ছে উঠতি নাট্যদলগুলো। তাই মহড়ার জন্য আলাদাভাবে ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। শিল্পকলায় সম্ভব না হলে অন্য কোথাও তা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন নাট্য-সংশ্লিষ্টরা।

মিলনায়তন সংকট

মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য যেমন ভালো পা-ুলিপি, নাট্যকার, নির্দেশক বা মহড়াকক্ষ জরুরি; তারও আগে প্রয়োজন মিলনায়তন। ইদানীং মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে সবমিলিয়ে মঞ্চ রয়েছে ছয়টি। নাট্যামোদীদের চাহিদা মেটাতে বাকিগুলো অপ্রতুল বলে নাট্যকর্মীদের অভিমত। উত্তরা, টঙ্গী, গুলশান, বনানী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার দর্শক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাটক দেখতে পারেন না। আরণ্যক নাট্যদলের সভাপতি বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘জাতীয় নাট্যশালা নাট্যকর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। এ মঞ্চে নাটক ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়ার সরকারি নীতিমালা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পাবলিক লাইব্রেরি ও জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে নাটক করা সম্ভব হলেও দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হয় বিধায় নাট্যদলগুলো নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী হয় না। এ দুটি মিলনায়তনের ভাড়া কমানো জরুরি।’

 

মঞ্চে বড় দলের প্রভাব

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত নাট্যদলগুলোর মধ্যে থিয়েটার মঞ্চে বড় কয়েকটি দলেরই প্রভাব বেশি দেখা যায়। ছোট দলগুলোর প্রতিভা ও সাংগঠনিক সবলতা থাকা সত্ত্বেও ঠিকমতো পাচ্ছে না মঞ্চ আর মহড়াকক্ষ। অন্যদিকে ছোট দলগুলোকে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় বারবার।  ঠিকমতো প্রযোজনা মঞ্চস্থ না করতে পারার কারণে নাট্যকর্মীরা হতাশ হয়ে থিয়েটারে নিয়মিত চর্চায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এ বিষয়ে নাট্যজন আতাউর রহমান বলেন, ‘বড় দলগুলো মূলত দলের নাট্যচর্চার ঐতিহ্য ও নাটকের মান বিবেচনা করে হল ও মহড়াকক্ষ পায়। তারা তো থিয়েটারের পথপ্রদর্শক, তারা তো অগ্রাধিকার পাবেই। আর পাবে না কেন! ছোট দল ভালো কাজ করলে কিন্তু আমরা তাদেরও বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিই।’

 

নিরুৎসাহিত তরুণ নির্দেশক

উপযুক্ত মূল্যায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তরুণ নির্দেশকরা মঞ্চনাটকে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘আমার মতে এখনকার তরুণ নির্দেশক যাঁরা আছেন সবাই অনেক ভালো করছেন। তাঁদের কাজ এখন বিশ্বমানের বলা চলে। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা যে ভালো ভালো কাজ করছে তার জন্য উৎসাহ দেওয়ার কেউ নেই। তাঁদের অনুপ্রেরণা আমরা দিতে চাই না। সে জন্য তাঁরা তাঁদের ঠিকমতো মেলে ধরতে পারছে না।’

 

এলাকাভিত্তিক মঞ্চ নেই

রাজধানীতে বেইলি রোডস্থ মহিলা সমিতি মিলনায়তন ও সেগুনবাগিচায় অবস্থিত শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক প্রদর্শনী বেশি হয়। নাটক প্রদর্শনীর জন্য সাধারণত এই দুই জায়গায় উপযোগী মিলনায়তন আছে। বাকি তেমন করে কোনো এলাকায় মিলনায়তন নেই বললেই চলে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের জহির রায়হান মিলনায়তন বা নাটমন্ডলের মঞ্চে তেমন করে নাটক প্রদর্শনীও হয় না। তাই দর্শক সংকট কাটিয়ে উঠতে ঢাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মঞ্চ নির্মাণ খুবই জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

দল ভাঙন

মঞ্চের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে দলের ভাঙন। বিভিন্ন সময় দলের কর্তাব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত, মতানৈক্য বা প্রভাবে কিছু সদস্য দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন। যদিও দলের ভাঙনে নতুন নতুন দল সৃষ্টি হয়ে ভালো ভালো কিছু প্রযোজনা উপহার পেয়ে থাকে মঞ্চনাটকের দর্শক।

 

হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা

হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা যেন কাটছেই না। হল বরাদ্দ নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। শুক্রবার সব দলের কাছে নাটক প্রদর্শনীর সর্বোত্তম দিন। যদিও বড় দলগুলো বিভিন্নভাবে দিনটিতে হল বরাদ্দ পেয়ে থাকে। বিগত সময়ও একাধিকবার এই অনিয়ম নিয়ে অনেক দলই জোর আওয়াজ তুলেছিল। কিন্তু হল বরাদ্দ কর্তৃপক্ষ সেটিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন বারবার। সম্প্রতি হল বরাদ্দ কমিটির তড়িঘড়ি একটি সিদ্ধান্তে সব দলের নজর আটকে যায়। ২২ মে প্রকাশিত শিল্পকলা একাডেমির নোটিস বোর্ডে একসঙ্গে দুটি হল বরাদ্দ তালিকা শোভা পায়। নাট্যদল বাতিঘরের বরাদ্দকৃত এক্সিপেরিমেন্টাল হল ডেট পরিবর্তন করে এথিক নাট্যদলকে সেই দিনটি (শুক্রবার) দেওয়া হয়। যেটি রীতিমতো নিয়মবহির্ভূত। যা নিয়ে সর্বমহলে চলছে নিন্দা। এদিকে হল বরাদ্দ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেও এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর