বুধবার, ১৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
এফডিসিতে ছবির খবর নেই

কাদা ছোড়াছুড়িতে বাড়ছে উদ্বেগ

আলাউদ্দীন মাজিদ

কাদা ছোড়াছুড়িতে বাড়ছে উদ্বেগ

এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ হয় না বললেই চলে। সেখানে এখন বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের মানুষ যায় গালগল্প,  কাদা ছোড়াছুড়ি, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে জড়িত হতে।

এফডিসিতে কাজের চেয়ে সবাই ব্যস্ত সংগঠন আর একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে।  বলতে গেলে বলা যায়, কর্মশূন্য এফডিসিতে সবাই এখন ব্যস্ত সমিতি আর পরস্পরের দ্বন্দ্ব নিয়ে।

 

‘কোথায় ছবি, কোথায় সিনেমা হল...’ ঢাকাই চলচ্চিত্রের এমন দৈন্যদশা বলতে গেলে নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে। পর্যাপ্ত ও মানসমম্মত ছবির অভাবে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে এখন এর সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। একই সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় সবই। হাতে গোনা কয়েকটি সংস্থা খুঁড়িয়ে চলছে। নেই দর্শকগ্রহণযোগ্য পর্যাপ্ত শিল্পী।’ এই যখন ঢাকাই চলচ্চিত্রের অবস্থা তখন যেখানে ছবির খবর নেই সেখানে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন কীভাবে হবে তা নিয়ে চলচ্চিত্রের অধিকাংশ মানুষের যেন কোনোই মাথাব্যথা নেই, বরং অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন নানা নেতিবাচক কর্মকান্ডে। এতে করে ঢাকাই চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি বারবার হুমকির মুখে পড়ছে। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে টানাপোড়েনের কোনো সমাধান না হতেই নতুন করে জায়েদ খান-মৌসুমী-ওমর সানী ইস্যু তৈরি করেছেন নায়ক ওমর সানী। এ নিয়ে এখন চলছে চরম কাদা ছোড়াছুড়ি। আর তা দেখে হাসছে সাধারণ মানুষ, এসব ঘটনা ট্রল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব কোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়’, এমন মন্তব্য প্রখাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াতের।

চলচ্চিত্রবোদ্ধারা এই জগতের মানুষের বারবার নানা নেতিবাচক কর্মকান্ডে এখন চরম নাখোশ। তারা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে চলচ্চিত্রের মানুষের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সবাই ব্যস্ত সমিতি, দ্বন্দ্ব আর নেতৃত্ব নিয়ে। চলচ্চিত্রের একপক্ষ আরেক পক্ষকে কীভাবে ঘায়েল করবে সেটিই এখন কালচারে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায় ছবি নির্মাণ বা মুক্তি চলচ্চিত্রকারদের কাছে এখন মুখ্য বিষয় নয়, তাদের প্রধান চিন্তা হলো কীভাবে নেতা হওয়া যায়, নেতৃত্বে গিয়ে কতটা ফায়দা হাসিল করা যায়। এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ হয় না বললেই চলে। সমিতির ভারে সংস্থাটি এখন জর্জরিত। এফডিসিতে এখন বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের মানুষ যায়  গালগল্প, কাদা ছোড়াছুড়ি, পিকনিক, ইফতার পার্টিসহ নানা আয়োজনের নামে চাঁদা উত্তোলনের মতো স্বার্থ হাসিলের কাজে জড়িত হতে। এফডিসিতে এখন কোনো চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টকে ‘কি কাজ করছেন’ এমন প্রশ্ন করা হলে জবাব পাওয়া যায়, ‘নারে ভাই, হাতে কোনো কাজ নেই, এখানে এসেছিলাম অমুক সমিতিতে যাওয়ার জন্য, সেখানে বসে একটু গল্প করব, সময় কাটাব, এই আর কি?’ এফডিসিতে সমিতির নামে অফিস বানিয়ে বছরের পর বছর ঘর ভাড়াও বকেয়া রেখেছে বলে এফডিসি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ সিনিয়র চলচ্চিত্রকার বলছেন- ‘এফডিসিতে কাজের চেয়ে সবাই ব্যস্ত সংগঠন আর একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে। বলতে গেলে বলা যায়, কর্মশূন্য এফডিসিতে সবাই এখন ব্যস্ত সমিতি আর পরস্পরের দ্বন্দ্ব নিয়ে। স্বাধীনতা লাভের পর এখানে কাজের পরিধি যত বেশি ছিল দ্বন্দ্ব তত কম ছিল। এখন হয়েছে উল্টো, ছবি কম দ্বন্দ্ব বেশি।’ চলচ্চিত্র নির্মাণ তেমন না হলেও এফডিসিতে বাড়ছে সমিতির সংখ্যা। আগে ছিল ১৮টি সংগঠন, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯টিতে। এর নাম  দেওয়া হয়েছে ‘চলচ্চিত্র শিল্পী অধিকার রক্ষা ফোরাম’। এদিকে কাকরাইল ফিল্মপাড়ার সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। কমপক্ষে ২০১২ সাল পর্যন্ত দুই শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিস নিয়ে মুখর ছিল কাকরাইল। এখন সেখানে নেই ছবি, পোস্টার, সিনেমা হল মালিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পী কলাকুশলীদের পদচারণা। মানে প্রযোজনা সংস্থা শূন্য হয়ে পড়েছে ফিল্মপাড়া খ্যাত কাকরাইল। কাকরাইল ফিল্মপাড়ায় যমুনা ভবন, ভূঁইয়া ম্যানসন, রাজমণি ভবন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স, ফরিদপুর ম্যানসনে প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিস ছিল ২০০০ সালের প্রথম পর্যন্ত। এরপর দর্শকের অভাবে সিনেমা হল বন্ধ শুরু হলে লোকসান গুনে বন্ধ হতে থাকে প্রযোজনা সংস্থার অফিস। ২০২০ সালে করোনাকালে ১৮ মার্চ থেকে সিনেমা হল ও সিনেমা নির্মাণ বন্ধের আগে কাকরাইল ফিল্মপাড়ায় অবশিষ্ট ছিল হার্টবিট প্রোডকাশন, জননী কথাচিত্র, সজীব ফিল্মস, আশীর্বাদ চলচ্চিত্র, এনএন ফিল্মস, বেনানা ফিল্মস, মালঞ্চ কথাচিত্র, টি ও টি ফিল্মস, শাপলা মিডিয়া, কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্রের অফিস। করোনা মহামারির কবলে পড়ে ওই বছরের জুলাই মাসে বন্ধ হয়ে যায় হার্টবিট প্রোডাকশন, জননী কথাচিত্র, সজীব ফিল্মস। বাকিগুলো পুরনো ছবি ভাড়া দিয়ে নামেমাত্র টিকে আছে।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াতের কথায়, চলচ্চিত্রের মানুষের মধ্যে ঐক্য দিন দিন কমছে, আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এই শিল্পটির ওপর। চলচ্চিত্রের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের নেতিবাচক কর্মকান্ডে বারবার এই শিল্পটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এই অবস্থা একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যমের জন্য অসম্মানজনক। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্প বলে আর কিছুই থাকবে না।

সর্বশেষ খবর