সোমবার, ২০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
একান্ত সাক্ষাৎকারে দিলারা জামান

এখনো সুস্থ আছি-এটাই কম কী

এখনো সুস্থ আছি-এটাই কম কী

বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনো সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন বরেণ্য অভিনেত্রী দিলারা জামান। সদ্য ৮০-তে পা রাখা এই গুণী অভিনেত্রীর গেটআপ-মেকআপ সবাইকে চমকে দেয় মাঝে-মধ্যে। দিলারা জামানের দীর্ঘ জীবন ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন - পান্থ আফজাল

 

জন্মদিনের শুভেচ্ছা। গাড়িতে মনে হচ্ছে, শুটিং আছে নাকি?

আর জন্মদিন! বুড়াকালেও জন্মদিন পালন। তোমাকে ধন্যবাদ শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। গাড়িতে রয়েছি, শুটিং করতে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, গতকাল ৮০-তে পা রেখেছি।

 

বিশেষ দিনটি কীভাবে কাটালেন?

বিশেষ দিন বলে তেমন কিছু নেই। আমার কাছে সব দিনই বিশেষ দিন এখন। জন্মদিন উদযাপন করি না। মেয়েরা দেশে থাকলে উৎসাহ নিয়ে করে, আবার আমি তাদের কাছে থাকলেও করে। অভিনয় অঙ্গনে আমার সহকর্মীরাও উৎসাহ দেখায়। জন্মদিনের সকালটা কাটালাম চ্যানেল আইয়ের তারকা কথনে অংশ নিয়ে। সবাই কেক, ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাল। আর আড্ডাও হলো। তবে বিকাল থেকে সারা দিন বাসায়ই ছিলাম। ছেলে-মেয়েদের অনুরোধ-বাসায় সময় দিতেই হবে! বাসায় গিয়ে তো দুষ্টু ছেলে-মেয়েদের সারপ্রাইজ দেখে অবাক হয়েছি। ফুল-কেক কাটা হলো। আর নানা রকম সুস্বাদু রান্নার আয়োজন তো ছিলই। মেঘে মেঘে তো বেলা কম হলো না। এত দিন সুন্দরভাবে বাঁচতে পেরেছি, এখনো সুস্থ আছি-এটাই কম কী! মানুষের মনে জায়গা করে নিতে বা মানুষ যাতে সবসময় মনে রাখে, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। জানি না, কতটুকু মানুষ মনে রাখবে।

 

দীর্ঘ সময় চলে গেল জীবন থেকে...

এটা সত্যি, দীর্ঘ সময় পার করলাম। এটা প্রাপ্তি। আবার অনেক সহযোদ্ধাকেও হারিয়েছি। তাদের কথা খুব করে মনে পড়ে। তবুু আমি শুধু একলা যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছি। এই জনমে অনেক পরিবর্তন  দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, স্বাধীনতা যুদ্ধ-কত কিছু যে পার করে এসেছি। জন্মের পর আসানসোল থেকে যশোর, এরপর ঢাকায় এলাম। আর ’৬৪ সালে স্বামীর কর্মস্থলে। ৫০ বছরের দীর্ঘ সময় দাম্পত্য জীবন। এরপর তিনিও চলে গেলেন আমাকে একা রেখে। মেয়েরাও দূরে, একা থাকি। মাঝে মাঝে ওরা আসে, আমিও যাই।

 

জীবনে বড় প্রাপ্তি কী?

আমার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হলো মানুষের ভালোবাসা। আর জীবনে বড় বিস্ময় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা লাল-সবুজের দেশ পেয়েছি। আর পেয়েছি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার বড় প্রাপ্তি যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুটি কাজে আমি ছিলাম; মায়ের চরিত্রে। শ্যাম বেনেগালের নির্মাণে ‘মুজিব’ বায়োপিকে বঙ্গবন্ধুর মায়ের চরিত্রে কাজ করেছি-এটা খুবই আনন্দের।

 

এখনো সাবলীলভাবে নাটক করে যাচ্ছেন...

অভিনয় জগৎ আমার দ্বিতীয় সংসার। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে নাটক করার জন্য কোনো পরিচালক বা নির্মাতা অফার করলে ‘না’  বলতে পারি না। আর একজন শিল্পী কখনই তৃপ্ত হতে পারেন না। শিল্পী তৃপ্ত মানেই তো তাঁর প্রাপ্তি শেষ। তাঁর অপ্রাপ্তিগুলোই ভালো কাজের উৎস। তাই মৃত্যু পর্যন্ত শিল্পীর অতৃপ্তি বা আকাক্সক্ষা থেকে যায়। ভালো চরিত্রের ক্ষুধা থেকে যায়। আর এই অতৃপ্তি প্রতিনিয়ত পরিচালকরাই মেটানোর চেষ্টা করতে পারেন। এখনো শিক্ষকতা করছি, অভিনয় কখনো ছাড়িনি। সংসারও সামলাতে হচ্ছে।

 

নায়িকা থেকে মা- এই চরিত্র বৈচিত্র্যতার পালাবদল কেমন লাগছে?

নায়িকা তো ছিলাম। কিন্তু এখনো চরিত্রটাই উপভোগ করি। চরিত্রে যত ডাইমেনশন থাকবে, তত মানুষ গ্রহণ করবে। এখন আমাকে ‘মা’ বেশি মানায়। মা চরিত্রে অনেক অভিনয় করেছি। প্রখ্যাত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিন রাত্রি’ বা ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক থেকে শুরু করে এ যাবৎকালের প্রায় নাটক, চলচ্চিত্র-বিজ্ঞাপনে মায়ের চরিত্রেই অভিনয় করছি। আমার তো ভালোই লাগে-শুটিং সেটে সবাই আমাকে ‘মা’ বলে ডাকে।

 

সেকাল-একালের নাটক-চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

সেকালের নাটক-চলচ্চিত্র মানে একটি টিমওয়ার্কের সম্মিলিত কাজ। তখন কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি এত অগ্রসর ছিল না। কিন্তু এখন দুঃখ লাগে, ভালো গল্প, শিল্পী ও চলচ্চিত্রের অভাবে হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আত্মমুখী হয়ে যাচ্ছে। ঈদের নাটক পর্যন্ত কেউ দেখে না চ্যানেলে।  খারাপ জিনিসের ভিউ বেশি। ভালো কনটেন্টের খবর নেই।

 

আপনাকে খুব কম চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে। মঞ্চে কি ফের দেখা যাবে?

বড় পর্দায় অনেক কাজ করেছি। এখনো করছি। করেছি গুনিন, গোর, মানিকের লাল কাঁকড়া, শ্যাম বেনেগালের মুজিব, টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই, চিরঞ্জীব মুজিব, কাগজের বউ, ক্ষমা নেই, সুবর্ণভূমিসহ চ্যানেল আইর কিছু কাজ করেছি। সম্প্রতি শেখ রাসেলকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রে শেখ রাসেলের স্কুলের প্রিন্সিপাল চরিত্রে অভিনয় করেছি। আর আপাতত মঞ্চে কাজ করছি না। আগে মঞ্চ, টেলিভিশন, রেডিওতে একযোগে কাজ করেছি, এখন আর পারি না।

 

দর্শক পারিবারিক গল্প খুঁজে পাচ্ছে না। এটা কি সময়ের চাহিদা?

যে জীবন এবং সংস্কৃতি দেখানো হচ্ছে তা আমাদের মূল্যবোধের বাইরে। হয়তো পুরনো দিনের মানুষ বলেই এটা আমার খারাপ লাগে। জীবন ও বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করছি। আমরা চকচকে জিনিস নিয়ে পড়ে আছি। ছাই বা ময়লার মধ্যেও যে ভালো কিছু থাকে সেটা খোঁজার চেষ্টা ও ধৈর্য নেই। যারা লেখেন, নাটক পরিচালনা করেন সবাইকে আমি দোষ দেব। একই সঙ্গে চ্যানেলগুলোরও দোষ আছে। তারা বলে দেয়, উমুককে নিতে হবে, উমুককে নেওয়া যাবে না। এখনকার নাটকে ভিউর সিস্টেম খুবই খারাপ, শিল্পটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা হঠাৎ অল্প কিছু নিয়ে সাময়িক অস্থির থাকছি।

 

নিজেকে কতখানি স্মার্ট মনে হয়?

আমি তো পুরনো ধ্যানধারণা নিয়েই আছি, থাকব। এখনো আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারি না। ১৯৯৬ সালে যে মোবাইল কিনেছি, বাটন টিপে আজও সেটাই ব্যবহার করছি। আমার কাছে এটাই স্বস্তির মনে হয়। এখনো সকালবেলা দরজা খুলে দেখি, পত্রিকাটা আসছে কি না। চা-নাস্তা বানিয়ে খেতে খেতে হাতে নিয়ে পত্রিকা পড়ি। অন্যরা সবাই যেখানে স্মার্টফোনে সব খবর জেনে নিচ্ছে, আমার তা হয় না।

 

মডেলিংয়ে বেশ সাড়া ফেলেছেন। বিষয়টি কতখানি উপভোগ্য?

কিছু ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের কভারে স্থান পেয়েছে এই বুড়া বয়সের ওয়েস্টার্ন লুক। অনেকে এপ্রিসিয়েট করেছেন। এরপর আরও অনেক বিজ্ঞাপনী প্রচ্ছদের মডেল হয়েছি। আসলে কাজের স্বীকৃতিটা হচ্ছে বড় কথা। আমি তো কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কাজ করি না। সবাই ভালোবেসে গ্রহণ করছে, এটাই অনেক বড় পাওয়া, ভালোবাসা।

 

এই বয়সেও নাকি নিজ হাতে রান্না করেন?

আমার বিয়ে হয়েছে ৫৭ বছর। বিয়ের পর আমার শাশুড়ি বললেন আমি আমার ছেলে-মেয়েদের কখনো কাজের মানুষের হাতের রান্না খাওয়াইনি। এ কথা শোনার পর থেকে আমি নিজেই রান্না শেখা শুরু করলাম। তখন থেকে এখন পর্যন্ত নিজেই রান্না করি। সবাই বলে রান্নার জন্য একজন কাজের লোক রাখেন। কিন্তু না, আমি নিজেই রাঁধতে পছন্দ করি।

 

জীবনের প্রথম কাজের সম্মানী কত ছিল?

জীবনের প্রথম নাটকে অভিনয় করে পেয়েছিলাম ৭৫ টাকা সম্মানী। সময়টা ১৯৬৫ সাল। তখন এটা অনেক টাকা। সে সময় আধা ঘণ্টা ও ৪৫ মিনিটের নাটক হতো। রেডিওতে একটি নাটকে কাজ করলে তখন ১৫ টাকা করে পেতাম। ওসব দিনগুলো অনেক কষ্টের হলেও এখনো খুব মধুর মনে হয়।

 

বন্যায় মানুষের জীবন এখন দুর্দশাগ্রস্ত...

খুবই দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে সবাই। সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনাসহ দেশের প্রায় অংশেই পানি বাড়ছে। সবাই কি করুণ অবস্থায় আছে-বলার বাইরে। ওষুধ নেই, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। ত্রাণ পৌঁছে দিতেও পারছে না অনেকে। বিষয়গুলো ভাবলেও কষ্ট হয়। মানুষ, পশু-প্রাণী কষ্টে রয়েছে। প্রার্থনা করছি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

 

একটা বিশেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাই।

একটি ‘বৃদ্ধাশ্রম’ করব, যেটা আমার স্বপ্ন। বুড়া মানুষের অসহায়ত্ব দেখেছি। শেষ বয়সে এসে তো তাঁরা শিশুর মতো হয়ে যান, তখন তাঁদের আর সেভাবে দেখার মতো কেউ থাকে না। অথচ এই সময়টায় তাঁরা থাকেন খুব অসহায়, কিছু বলতেও পারেন না। মা-বাবারা তখন বিষয়গুলো নিজেই উপলব্ধি করতে পারেন; কিন্তু আপন সন্তানরা পারে না।

সর্বশেষ খবর