বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ছবি আছে দর্শক কোথায়?

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবি আছে দর্শক কোথায়?

‘এতদিন বলে এসেছি পর্যাপ্ত পরিমাণে ও মানসম্মত ছবি না পেলে সিনেমা হলে দর্শক কীভাবে আসবে, এতে সিনেমা হল খোলা রেখে লোকসান গোনার কোনো মানে হয় না। তবে চলতি বছর একটু আশার আলো দেখছিলাম। প্রতি মাসে গড়ে তিনটি করে ছবি মুক্তি পাচ্ছিল। যেখানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যাই মাত্র অর্ধশতের মতো, সেখানে এই সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু তাতেও আবার আশার আলোতে হতাশার অন্ধকার ভর করেছে। ঈদ ছাড়া বাকি সময় মুক্তি পাওয়া ছবিগুলো দর্শক টানতে পারেনি। তাই এবার বলতে হয়, ‘ছবি আছে কিন্তু দর্শক কোথায়?’ দর্শক না থাকার কারণ কি? আসলে এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট নির্মাতারা যদি দর্শকদের করেন তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য লাভ হবে। কারণ দর্শক বলছে, সিনেমা হলে অনেক আশা নিয়ে বিনোদন পেতে ছবি দেখতে যাই। কিন্তু ছবির গল্প, নির্মাণ আর অভিনয় যদি মনে না ধরে তাহলে সেই ছবি কেন দেখতে যাব। দর্শকদের এমন হতাশামাখা জবাব সিনেমা হল মালিকদের আবার উৎকণ্ঠিত করে।’- গত ছয় মাসে মুক্তি পাওয়া ছবির ব্যবসা নিয়ে এমন উদ্বেগ এবং ক্ষোভ ঝরা মন্তব্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদের।

‘কাজী শোয়েব রশীদের বক্তব্যের রেশ ধরে যদি গত ছয় মাসে মুক্তি পাওয়া ছবির সফলতা-ব্যর্থতার চিত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখব ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। কারণ গত ছয় মাসে প্রায় ১৮টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এরমধ্যে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-টু’ ও ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ এবং ‘গলুই’ ছাড়া আর কোনো ছবির বেলায় সিনেমা হলে দর্শক দেখা যায়নি।’ বললেন, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল। চলতি বছরের এই প্রথম ৬ মাসে ১৮টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবিগুলো হলো- ‘ছিটমহল’, ‘তোর মাঝেই আমার প্রেম’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, ‘মাফিয়া-১’, ‘মুখোশ’, ‘শিমু’, ‘গুণিন’, ‘লকডাউন লাভ স্টোরি’, ‘জাল ছেঁড়ার সময়’, ‘বিদ্রোহী’, ‘গলুই’, ‘বড্ড ভালোবাসি’, ‘শান’, ‘পাপ-পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘বিক্ষোভ’, ‘তালাশ’ ও ‘অমানুষ’। চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, কোনোটিই সিনেমা হল থেকে পুরো ব্যয় তুলে আনতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রযোজকরা এখনো হতাশ নন। তাদের কথায় ওটিটি প্ল্যাটফরম, টিভি স্বত্ব, ডিজিটাল স্বত্ব, স্পন্সর ও দেশের বাইরে মুক্তির ব্যবস্থা ছবির জন্য আয়ের বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাই ছবিতে লগ্নিকৃত অর্থ হয়তো এসব মাধ্যম থেকে লভ্যাংশসহ ফেরত আসতে পারে। ছবি মুক্তিতে বছরের শুরুটা ছিল ‘ছিটমহল’ দিয়ে। প্রথম ছবিতেই হতাশা, ছবিটি দর্শক সিনেমা হলে এসে দেখেনি। ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়া দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’-এর সফলতা চলতি বছরের প্রথম আশাজাগানিয়া ছবি। ছবির পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস জানান, ‘ছবিটি এখনো দেশের নানা সিনেমা হলে চলছে এবং ঈদুল আজহায় নতুন করে আবার মুক্তি পাচ্ছে। তাই নির্মাণ ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ সিনেমা হল থেকেই ওঠে আসবে। ইউটিউবে ছবির তিনটি গান থেকে ভালো আয় করেছে। পাশাপাশি আরটিভি ছবিটি যখন ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার করবে, সেখানেও ভালো আয় হবে। সবকিছু মিলিয়ে শতভাগ লাভজনক প্রকল্প। তাই ছবির ব্যবসা এখন শুধু সিনেমা হলে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কারণ নানা কারণে আগের মতো দর্শক এখন সিনেমা হলে আসতে চায় না। তবে লগ্নিকৃত অর্থ ও মুনাফা তুলে আনার প্রধান শর্ত হলো মানসম্মত কনটেন্ট। গত ঈদে মুক্তি পায় শাকিব খানের দুই ছবি- ‘গলুই’ ও ‘বিদ্রোহী’। একই সময় মুক্তি পায় সিয়াম-পূজার বিগ বাজেটের ছবি ‘শান’। এই তিন ছবির মধ্যে ‘শান’ আর ‘গলুই’ আশানুরূপ দর্শক টেনেছে সিনেমা হলে। যা অন্য ছবির নির্মাতাদের জন্য উৎসাহ ও প্রেরণা জোগায়। সরকারি অনুদান পাওয়া ‘গলুই’-এর প্রযোজক খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমার ছবির খরচ আড়াই কোটি, তার মধ্যে ৬০ লাখ টাকা অনুদান। এ কথাই বলতে পারি, আমার খরচ উঠছে। কেবল তো দুই মাস চলছে। এরপর অনেক সময় পড়ে আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে। প্রেক্ষাগৃহ থেকে ভালো অঙ্কের অর্থ পেয়েছি। বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভালো চললে লভ্যাংশ শেয়ারিংও হবে। অস্ট্রেলিয়া থেকেও যোগাযোগ করেছে। বর্তমান বাজার থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা তুলতে পেরেছি, এটাই অনেক বড় ঘটনা। আমি খুবই আশাবাদী। ১০০-এরও কম হল নিয়ে এতটা আসতে পেরেছি, এটাই অনেক বড় বিষয়। হল বাড়লে এই সংকট থাকবে না।’ ‘শান’-এর প্রযোজক ও কাহিনিকার আজাদ খান লগ্নির টাকা এখনো ওঠে না এলেও চিন্তিত নন। তিনি বলেন, ‘এত টাকা এত কম সিনেমা হল থেকে অল্প সময়ে তোলার কথা আশা করাই যায় না। তবে লগ্নি ফেরত অবশ্যই আসবে। ছবিটি দর্শক পছন্দ করেছে। এখনো সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে।’

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, ঈদে শাকিব খান ও সিয়ামের দুই ছবি দেখতে সিনেমা হলে এসেছিলেন দর্শক। তা দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলেন হল মালিকরা। চলচ্চিত্রের মানুষরাও ভেবেছিলেন, শিল্পের মন্দার দিন বোধ হয় কাটতে চলেছে। তবে তার কিছুই হয়নি। আবার দর্শকশূন্য সিনেমা হল। এর মধ্যে কটি তারকাবহুল ছবিই মুক্তি পায়। ‘পাপ-পুণ্য’ নামের ছবিটি দর্শক কেন দেখেননি বুঝলাম না। কারণ এই ছবি দিয়েই দীর্ঘদিন পর জুটি বেঁধেছিলেন ‘মনপুরা’ ছবির নায়ক চঞ্চল চৌধুরী ও পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম’। ‘পাপ-পুণ্য’ ছবির চেয়েও করুণ চিত্র প্রায় ৯০ লাখ টাকায় নির্মিত ‘আগামীকাল’ ছবির। অঞ্জন আইচের এই ছবিটি দর্শক সাড়া পায়নি। ‘আগামীকাল’ ছবির ব্যাপারে ঢাকার শ্যামলী সিনেমার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আহসানউল্লাহ বলেন, ‘এই ছবিটি মোটেও চলেনি। ঢাকার ‘আনন্দ’ সিনেমা হলের কর্মকর্তা শাহ দুলাল বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থা এই ছবির। প্রতি শোতে মাত্র চার থেকে পাঁচজন দর্শক পেয়েছি।’ ১০ জুন মুক্তি পাওয়া ‘বিক্ষোভ’ শিরোনামের তারকাবহুল এই ছবিটি নিয়ে সিনেমা হল মালিকদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কলকাতার অভিনেত্রী শ্রাবন্তী ছিলেন সেই প্রত্যাশার পক্ষের বাজি। তবে সেখানেও ব্যর্থতা। বলা চলে, কোনো আলোচনাই পায়নি ছবিটি। সর্বশেষ ‘অমানুষ’ ও ‘তালাশ’ নিয়েও সিনেমা হল মালিকদের মধ্যে চলছে হতাশা। তবে অনেক সিনেমা হল মালিক বলছেন, ছবি দুটি মুক্তি পেয়েছে দেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে। মুক্তির দিন থেকেই দেশজুড়ে থেমে থেমে চলছিল বৃষ্টি। এমন আবহাওয়ার মধ্যে দর্শক আশা করাও মুশকিল। ১৭ জুন মুক্তি পাওয়া ‘তালাশ’ ও ‘অমানুষ’ ছবির ব্যবসা নিয়ে নানা সিনেমা হলের নানা মত থাকলেও ‘তালাশ’-এর পরিবেশক অভি কথাচিত্রের জাহিদ হাসান বলেন, ‘বর্তমানে হল থেকে ৩০-৫০ শতাংশ লগ্নি ফেরত আসা সম্ভব। বাকি লগ্নি ফেরত আসবে ওটিটি, ডিজিটাল মাধ্যম, স্পন্সর, টিভি স্বত্ব, বিদেশে মুক্তির পর আয় থেকে।’ তবে দিন শেষে লোকসান তো গুনতে হচ্ছে সিনেমা হল মালিকদেরই। সিনেমা হল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মানে সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে মানসম্মত ছবির বিকল্প নেই। এ কথাটাই এখন নির্মাতাদের মনে রাখতে হবে। বললেন, ঢাকার মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখারউদ্দীন নওশাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর