মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

পরাণ ও হাওয়ার বাজিমাত

আলাউদ্দীন মাজিদ

পরাণ ও হাওয়ার বাজিমাত

বদলে গেছে ঢাকাই ছবির চালচিত্র। সিনেমা হলে এখন সেই সোনালি দিনের চেহারা, কাউন্টারে টিকিট নেই, সিনেমা হলের সামনে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়, ব্ল্যাকেও বিক্রি হচ্ছে টিকিট। সব শ্রেণির দর্শক সপরিবারে সিনেমা হলে আসছে। এমন চিত্র দেখা   গেছে সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ছবির আকাশছোঁয়া সাফল্যে। ছবি দুটি হচ্ছে ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’ ও ঈদের পর আসা ‘হাওয়া’। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ছবি দুটি বাজিমাত করে চলছে। এই দুই ছবির এমন সাফল্যে অন্য নির্মাতারাও ছবি নির্মাণে ও মুক্তিতে এখন ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিগত অনেক বছর পর এমন দৃশ্যে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বইছে সুবাতাস। টিকিট সংকটে ‘হাওয়া’র নায়িকা নাজিফা তুষিও হলের ফ্লোরে বসেই সিনেমাটি উপভোগ করেছেন। দেশের সব জায়গায়ই মুক্তির প্রথম দিন থেকে ছবি দুটির প্রতিটি শো হাউস ফুল চলছে। প্রেক্ষাগৃহগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিক্রি হচ্ছে ‘হাওয়া’ সিনেমার অগ্রিম টিকিট। ঢাকার বাইরে থেকে অনলাইনেই কেনা হচ্ছে টিকিট। বেশ কটি শো আগে থেকেই হয়ে আছে হাউস ফুল। দেশের অভিজাত চেইন স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো আধুনিক প্রেক্ষাগৃহগুলো লুফে নিয়েছে ‘হাওয়া’। নারায়ণগঞ্জের সিনেস্কোপ প্রেক্ষাগৃহের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, ‘আমরা দর্শকদের কাছে সরি বলছি। কারণ এত চাপ কোনো টিকিট নেই। ভেবেছিলাম, তিন-চার দিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির পর হয়তো দর্শকদের সরাসরি সিনেমার টিকিট দিতে পারব কিন্তু সেটা হচ্ছে না। রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলা ছবির জোয়ার চলে এসেছে। যারা অভিযোগের সুরে বলেন, বাংলা ছবির দর্শক নেই, তাদের ধারণাটা ভুল প্রমাণ হয়েছে। ভালো ছবি হলে দর্শকরা অবশ্যই তা দেখেন।’ ঢাকার মধুমিতায় সিনেমাটির তিনটি শো হাউসফুল হয়েছে। মধুমিতা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মধুমিতা হলের জন্য এটি রেকর্ড। ‘হাওয়া’ সত্যিই বাজিমাত করল। গত পাঁচ-ছয় বছরে মধুমিতা হলে এমন রেকর্ড আর কোন সিনেমা করেনি। এভাবে যদি দর্শক হলমুখী হয় তাহলে বাংলাদেশের সিনেমার দৃশ্য বদলে যাবে। প্রযোজকরা নতুন করে ভাববেন। বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক রুকুনুজ্জামান ইউনুস রুবেল জানান, ‘হাওয়া’ আক্ষরিক অর্থেই হাউসফুল হয়ে বক্স অফিস হিট করেছে। এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় ‘পরাণ’ সিনেমা বাজিমাত করেছে, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে মুক্তি পায় ‘পরাণ’ সিনেমা। প্রিমিয়ার শোসহ ১৭টি শোর আগাম টিকিট বিক্রি হয়ে যায়।  অস্ট্রেলিয়ার হয়েটস ব্ল্যাকটাউন থিয়েটারে ১২ আগস্ট পরাণের প্রিমিয়ার শো হয়েছে। অন্যদিকে ‘পরাণ’ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। দর্শকরা ছবিটি দেখে প্রশংসা করছেন। এদিকে ‘হাওয়া’ ছবিটি দেশের দর্শকের হৃদয় জয়ের পর এবার উত্তর আমেরিকায় মুক্তি পাচ্ছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত এই ছবি সেখানে মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পরিবেশক-পরিবেশক ‘স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো’র প্রেসিডেন্ট অলিউল্লাহ সজীব জানান, এবারই প্রথম উত্তর আমেরিকার বড় সিনেমা চেইন (কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম সিনেমা চেইন, ল্যান্ডমার্ক সিনেমাস) নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তাদের দুটি থিয়েটারে ‘হাওয়া’ চালানোর জন্য পরিবেশককে (স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো) খুঁজে বের করেছে। এমন ঘটনা আগে স্বপ্নের মতো ভাবা হতো। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো সিনেমার অগ্রিম টিকিট মুক্তির এক সপ্তাহ আগে থেকে বিক্রি করা শুরু করেছে দুটি সিনেমা চেইন। কানাডার প্রধান সিনেমা চেইন ‘সিনেপ্লেক্স এন্টারটেইনমেন্ট’ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্যামাইকা মাল্টিপ্লেক্স সিনেমাস’ ২৫ আগস্ট থেকেই বিক্রি করছে ‘হাওয়া’র টিকিট। ‘হাওয়া’ একযোগে কানাডা ও আমেরিকার ১১৭টি থিয়েটারে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। রাজধানীর সিনেপ্লেক্সগুলোতে পরাণ ও হাওয়া নিয়ে দর্শকের এমন উন্মাদনায় বহুল আলোচিত হলিউড ছবি ‘থর : লাভ অ্যান্ড থান্ডার’-এর প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়। যা প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। যাঁরা এতদিন সিনেমা মুক্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁরা নড়েচড়ে বসেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাঁদের ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত শুটিং শেষ করে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিচ্ছেন কোনো কোনো পরিচালক। নতুন পরিচালকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় পর্দার চ্যালেঞ্জ নিতে। পরাণ ও হাওয়ার সাফল্যে ছোট পর্দার সাগর জাহান, কাজল আরেফিনসহ বেশ কয়েকজন সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সব ঠিক থাকলে চলতি বছর মুক্তি পেতে পারে ‘মুজিব দ্য মেকিং অব আ নেশন’, ‘লিডার আমি বাংলাদেশ’, ‘অন্তরাত্মা’, ‘নূর’, ‘রিকশা গার্ল’, ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘দামাল’, ‘অন্তর্জাল’সহ একডজনের বেশি সিনেমা। দর্শককে সিনেমা হলে আনতে হলে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে বললেন গাজী রাকায়েত।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাওয়া ও পরাণ ছবির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ভালো সিনেমার জন্য মুখিয়ে থাকে দর্শক। দেশি ছবিতে গল্পের নতুনত্ব ও উৎকৃষ্ট নির্মাণশৈলীর খোঁজ পেলে তারা ঠিকই হলে ফিরে যান। পরিবার নিয়ে হই-হুল্লোড় করে ছবি দেখে কাটিয়ে দিচ্ছেন সুন্দরতম সময়। আর সময়োপযোগী গল্পের আশ্রয়ে নিজস্ব ভাষায় ছবি নির্মাণ করে সেই কাজটিই করেছেন মেজবাউর রহমান সুমন ও রায়হান রাফির মতো নির্মাতারা। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, কেমন করে দর্শককে হলে টানতে হয়। কেমন করে সময়কে ধারণ করে বলতে হয় নতুন গল্প। দর্শক মাতিয়ে রাখা তরুণ নির্মাতাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন গেরিলা ও একাত্তরের যীশুর মতো দর্শকসমাদৃত চলচ্চিত্রের পরিচালক নাসির উদ্দীন।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নির্মাতা বলেন, হাওয়া ও পরাণ ছবির মাধ্যমে যেন দেশজ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে উত্থান ঘটেছে। মেজবাউর রহমানের হাওয়া ও রায়হান রাফির পরাণ যেভাবে দর্শককে হলে ফিরিয়ে এনেছে, সেটা আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য খুবই ইতিবাচক। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশীদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক ছিল সিনেমা হলের পরিবেশের জন্য দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আসে না। হাওয়া ও পরাণ প্রমাণ করেছে ভালোমানের ছবি ও ভালো গল্প হলে ঠিকই দর্শক হলে আসে। আগে ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির কারণে মৌসুমি হল খুলত। এখন এই ছবিগুলোকে ঘিরে চালু থাকা হলের পাশাপাশি মৌসুমি হলগুলোও খুলে  গেছে। ধুঁকতে থাকা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বিষয়টি খুবই ইতিবাচক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর