সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গাজী মাজহারুলের শেষ কথা

গাজী মাজহারুলের শেষ কথা

প্রয়াত গাজী মাজহারুল আনোয়ার, একাধারে যিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি গীতিকার, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক। প্রায় ২০ হাজার গানের স্রষ্টা ও সর্বকালের সেরা গীতিকারদের একজন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ স্পেশাল আড্ডায় এসেছিলেন এই গুণী মানুষটি।  কথা বলেন তাঁর জীবনের গল্প নিয়ে। তাঁর সেই বলা কথা তুলে ধরেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব

বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। সেই হিসেবেই পড়াশোনা। যখন এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন দেখলাম ‘মরা মানুষ কাটতে হবে’। এটা সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই শিল্প সংস্কৃতির প্রতি আমার মনের টান ছিল। পড়াশোনায় আমার অমনোযোগী ভাব দেখে আমার এক সহপাঠী বলল, তুমি ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কর। মেডিকেল কলেজে নাটক হতো। নাটকের জন্য গান লিখতাম। একটি গান লিখলাম ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। ফরিদা ইয়াসমিনের গানটি পছন্দ হলো। তিনি রেডিওতে গানটি গাইলেন। তুমুল জনপ্রিয় হলো। কিন্তু গীতিকার হিসেবে আমার নাম প্রচার হলো না। মনে খুব কষ্ট পেলাম। ডাক্তারি পড়া আর হলো না। মগবাজারের একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকি। গান লিখি। বাবা জানলেন না তার ছেলে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে গান লিখছে।

 

সুভাষ দত্ত আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন

একদিন সংগীত পরিচালক নাজমুল হুদা আমাকে নিয়ে আরেক সংগীত পরিচালক সত্য সাহার কাছে গেলেন। সত্য দা আমাকে নিয়ে প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্তের কাছে গেলেন। সুভাষ দত্ত তখন ‘সুতরাং’ ছবি বানিয়ে ফ্রাঙ্কফুট থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়ে খুবই বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সুভাষ দত্ত আমাকে দেখে সত্য দাকে বললেন, এই ছেলেটাকে কোথা থেকে ধরে এনেছ। সত্য দা বললেন, দাদা ও গান লেখে, তাকে নিয়ে ট্রাই করে দেখুন না। তিনি বললেন, ধুর, আমি সুভাষ দত্ত। আমার ছবির গান ও কীভাবে লিখবে? সত্য দা একটু বিব্রত হয়ে বললেন, দাদা এসেছে যখন একটু চেষ্টা করে দেখুন না। কিছু একটা হতেও পারে। আপনি ছবির গানের একটি সিচুয়েশন দেন। সুভাষ দত্ত অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে শিক্ষক ছাত্রীকে পড়াচ্ছেন এই সিচুয়েশনের ওপর একটি গান লিখতে বলেন। এতটুকু বিষয় নিয়ে কী গান লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপরও ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে গানটি তৈরি করে ফেললাম। গানের কথা ছিল ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ’। সত্য সাহা সুর করে সুভাষ দত্তকে গানটি শোনালেন। গানটি শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোমার চেহারা আর গোঁফ দেখে মনেই হয়নি তোমার মধ্যে ম্যাচুয়িরিটি এসেছে।

 

আবারও হতাশার অন্ধকার

‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটির রেকর্ডিং হলো এফডিসিতে। এই গানটি সুভাষ দত্তের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবির। বিকাল থেকে রেকর্ডিং শুরু হলো। শেষ হয় রাত ৩টায়। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। সবাই যার যার গাড়িতে চলে যাচ্ছে। আমার যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। পকেট ফাঁকা। কানাকড়িও নেই। দেখলাম ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার সবাইকে সম্মানী দিচ্ছেন। আমাকে কিছু দিলেন না। তার কাছে গিয়ে বললাম ভাই আমি কিছু পাব না। সে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাহ, গান লেখার সুযোগ পেয়েছ এটিই তো অনেক। আবার টাকা কীসের? যাও এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাও। আমার চোখে-মুখে তখন হতাশার অন্ধকার। চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রু বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে যাচ্ছি। এফডিসির গেটের কাছে যেতেই দারোয়ান বলল, কী ব্যাপার, এভাবে ভিজছো কেন? জ্বর উঠবে তো। আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম ‘আমার জ্বর উঠুক, অসুখ হোক, আমি মরে যেতে চাই’। দারোয়ান আমাকে গেটের পাশে তার রুমে জোর করে নিয়ে বসাল। তারপর বলল, এখানে কাজ পেতে হলে লাইন লাগে। মানে জানাশোনা বড় মাপের কারও রেফারেন্স দরকার। এমনি এমনি কিছু হবে না। যাও, ফিরে যাও। আর যদি এখানে আসতেই হয় তাহলে এমনভাবে আসবে যাতে রোদে পুড়তে আর বৃষ্টিতে ভিজতে না হয়। রীতিমতো গাড়ি চড়ে আসবে। তার কথায় আমার মনে জিদ চেপে গেল। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সেদিন বৃষ্টিভেজা কর্পদকশূন্য এই আমি প্রতিজ্ঞার পথ ধরে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

 

হিজ মাস্টার ভয়েজে গিয়ে ব্যর্থ হলাম

তখন হিজ মাস্টার ভয়েজ মানে এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ড বের হতো। একদিন এইচএমভিতে গিয়ে বললাম একটি গান দিতে চাই। প্রতিষ্ঠানের মালিক আমার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখালেন না। বললেন অমুক তারিখে আসেন। ওই তারিখে গেলে আবার বলতেন তমুক তারিখে আসেন। এভাবে তিনি যে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তা বুঝতে পারছিলাম এবং কষ্ট পাচ্ছিলাম।

 

এদেশে সর্বোচ্চ গান আমিই লিখেছি

এদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক গান লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এ পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি গান লিখেছি। কিন্তু সব গান আমার সংরক্ষণে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান যে বাঙালিদের ফাঁসির তালিকা তৈরি করেছিল সেই তালিকায় ১৩ নম্বরে ছিলাম আমি। ফলে আমাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে বাসায় ফিরে দেখি আমার গানের পান্ডুলিপিগুলো আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানেও আমার গানগুলো নেই। পাকবাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে আমার রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে।

 

গান রচনার সূচনা

১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করি। পাশাপাশি ওই বছরই বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করি। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখি ১৯৬৭ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে। অবশ্য ১৯৬২-৬৩ সালে  লিখেছিলাম প্রথম গান। সেই গানের কথা ছিল-‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’, যার সুর করেছিলেন নাজমুল হুদা বাচ্চু ও শিল্পী ছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লিখে ৫০ টাকা আয়ের মাধ্যমে পেশাদার গীতিকার জীবন শুরু করি।

 

বন্ধু বলল, তুই এই ঝুপড়িতে থাকিস?

আমি তখন মালিবাগের একটি টিনশেডের ঝুপড়ি ঘরে থাকি। আমার এক বন্ধু মাখন লন্ডন থাকত। সে এয়ারপোর্টে এসে আমাকে গাড়ি নিয়ে যেতে বলল। তার ধারণা আমি যখন গান লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছি নিশ্চয়ই আমার বেশ বিত্তবৈভব আছে। আমি গাড়ি পাব কোথায়? একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে গেলাম। সে অবাক হলো। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো আমার ঝুপড়ি ঘরে এসে। আমাকে বলল, এই কি তোর অবস্থা। ও জানত না গান লিখে ৫০ টাকা পেলে সবাইকে কমিশন দিতে দিতে আমার হাতে ১০টি টাকাও আর অবশিষ্ট থাকত না। বন্ধু বলল, তুমি সিনেমা বানাও। আমি বললাম সিনেমা নির্মাণের মতো অত টাকা কোথায় পাব? সে জানতে চাইল একটি ছবি বানাতে কত টাকা দরকার হয়। আমি বললাম তা তো ১ লাখ টাকা লাগবেই। বন্ধু সেই পরিমাণ টাকা দিতে চাইলে নিতে অস্বীকার করলাম। সে যেদিন লন্ডন ফিরে যাচ্ছে এয়ারপোর্টে গিয়ে বলল, ও হ্যাঁ আমি তোর বালিশের নিচে ভুল করে একটি প্যাকেট ফেলে এসেছি। ওটা তোর কাছে রাখিস। বাসায় এসে দেখলাম ১ লাখ টাকার একটি বান্ডিল। বুঝলাম আমি তো বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নেব না, তাই সে এই চালাকিটা করেছে। ভাবলাম সে যখন চায় আমি ছবি নির্মাণ করি তাহলে শুরুই করি।

 

১ লাখ টাকার সমাধির ব্যবসা ১৯ লাখ টাকা

দিলীপ বিশ্বাসকে পরিচালক এবং রাজ্জাক, সুচরিতা আর উজ্জ্বলকে নিয়ে নির্মাণ করলাম ‘সমাধি’। ১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিটি ১৯ লাখ টাকা আয় করল। এই টাকার অর্ধেক মানে সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিলাম আমার সেই বন্ধু মাখনকে। এরপর ২০ বছর ধরে যত ছবি নির্মাণ করেছি সব ছবির মুনাফার অর্ধেক দিয়ে এসেছি প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে। কারণ তার জন্যই তো আজ আমি চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সমাধির মুনাফার টাকা দিয়ে গাড়ি আর ফ্ল্যাট কিনলাম। সেই গাড়িতে চড়িয়ে বন্ধু মাখনকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিয়ে এলাম।

 

আমার স্ত্রীর ভূমিকা অন্যতম

আমার স্ত্রী যাকে সবাই জোহরা গাজী নামে চেনেন, আমার আজকের এ অবস্থান আর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অন্যতম। সে ইস্ট পাকিস্তান সময়কার একজন খ্যাতিমান অ্যাথলেট। তা ছাড়া বিটিভির জনপ্রিয় তারকা আড্ডা অনুষ্ঠান ‘বৈঠক’-এর আয়োজকও ছিল সে। এক সময় দেখলাম সে এসব কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সব ছেড়ে দিলে কেন? সে বলল আমরা দুজনই যদি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি তাহলে সংসার দেখবে কে? সংসারের জন্য তার এই ত্যাগ সত্যিই অভাবনীয়। আজও আমি মিডিয়া আর ও সংসার সামলাতে ব্যস্ত।

 

বাবা-মার পরেই আমার অন্তরে বঙ্গবন্ধুর স্থান

আজ আমি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার হতে পেরেছি বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার চুল টেনে ধরে বলতেন, তুই কখনই নড়বি না, সৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে যা। আমি তাঁর কথা রেখেছি, মোটেও নড়িনি, তিনি নড়েছেন; অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই দুঃখবোধ আমার চিরকালের।

প্রতিটি মানুষের কাজ আর প্রতিষ্ঠার পেছনে কারও উৎসাহ থাকে, আমার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা হলেন বঙ্গবন্ধু। আমি এখনো বঙ্গবন্ধুকে ভাবলে সমৃদ্ধ সুজলা সুফলা বাংলাদেশকে দেখি আর এই অনুপ্রেরণা থেকে এখনো লিখে যেতে পারছি।

 

দুঃখ একটাই...

সংস্কৃতি জগতে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুই প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করলেন। আমি সেই অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তাঁর হাত থেকে সেই অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার ভাগ্য আমার হলো না। কারণ এর আগেই দুষ্কৃতকারীরা তাঁকে হত্যা করল।

 

অসহায় শিল্পীদের রয়্যালিটি দেওয়া হোক

বর্তমানে কোনো শিল্পী অসুস্থ বা অসহায় হয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাকে অনুদানের জন্য যেতে হয়। আমাদের মহানুভব প্রধানমন্ত্রী কাউকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না। আমি বলব এভাবে প্রধানমন্ত্রী আর কত অনুদান দেবেন। ভারতে দেখেছি শিল্পীরা সারা জীবন যে কাজ করে তার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একটা সময় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে রয়্যালিটি দিয়ে যায়। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকার শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন হিসেবে জীবনের শেষ দিনগুলোতে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সম্মানী দিয়ে থাকে। ভারতে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মুঙ্গেশকরসহ আরও অনেককে এই সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই প্রথা চালু হলে ভালো হয়।

 

আমরা কেন হতাশায় থাকব...

আমি যখন ঢাকায় আসলাম তখন আমার মগবাজারের বাসার সামনে একটি আমগাছ ছিল। সেই গাছে একটি চড়ুইপাখি বাসা বাঁধলো। সারা দিন পাখিটি কিচিরমিচির করে উড়ে বেড়ায়। একদিন দেখলাম সে ডিম পেড়েছে। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটল। বাচ্চাগুলো সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে। মা পাখিটি সকালে উড়ে চলে যায়। বাচ্চাগুলোর জন্য আমার মায়া হয়। আমি ওদের খাবার দিই। কিন্তু তারা খায় না। বিকালে মা খাবার নিয়ে আসে। নিজের মুখ থেকে বাচ্চাদের মুখে খাবার পুরে দেয়। বাচ্চারা পরম তৃপ্তিতে খাবার খায়। আমার কথা হলো- ‘আমাদের তো পোলাও কোর্মার দরকার নেই, মা-বাবা পরিশ্রম করে আমাদের জন্য যা জোগাড় করে আনেন তা দিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকতে পারি। তাছাড়া একটি পাখি যদি গাছে তার জন্য একটি বসবাসের ব্যবস্থা করে নিতে পারে তাহলে আমরা মানুষ কেন আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে নিজেদের আশ্রয়ের জন্য এত হাহাকার করি, সংঘাত, মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হই। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে যার মতো করে কেন সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। আমি এক সময় পাখির কিচিরমিচির নিয়ে একটি গানি লিখেছিলাম। গানটি ছিল-‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয় না’। পরে গানটি আজিজুর রহমান সাহেব তার পরিচালিত ‘অতিথি’ ছবিতে ব্যবহার করেন এবং এখনো গানটি সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে।

 

মৃত্যুর সময় কলম সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই

জীবনে কতটা কাজ করতে পেরেছি কেমন করতে পেরেছি জানি না।  তবে মানুষের যে অবারিত ভালোবাসা পেয়েছি তাতেই আমার জীবন পূর্ণতায় ভরে গেছে।  আর কোনো অপ্রাপ্তি বা চাওয়ার কিছু নেই আমার। আমার এখন একমাত্র ইচ্ছা ‘মৃত্যুর পর একটি কলম যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।’


২০২১ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা পদক, স্মারক ও চেক

বাংলাদেশ প্রতিদিন গুণীজন সম্মাননায়

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ১৯ গুণীজনকে ২০২০-২১ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ প্রতিদিন। এতে প্রখ্যাত গীতিকার, কাহিনিকার, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক কিংবদন্তি গাজী মাজহারুল আনোয়ার এই সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা পদক, স্মারক ও চেক।

সম্মাননা প্রাপ্তির পর এক প্রতিক্রিয়ায় কিংবদন্তি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, এই সম্মাননা পেয়ে আমি গর্বিত। ‘আমরা জনগণের পক্ষে’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা করে বাংলাদেশ প্রতিদিন। সত্যিই পত্রিকাটি প্রকাশের পর থেকে জনগণের কথাই বলে আসছে। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরে তাদের দুর্দশা লাঘবে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ কারণে  সর্বস্তরের প্রিয় পত্রিকা এটি।

 


 

বিবিসির জরিপে সেরা

বিবিসি বাংলা জরিপকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা তিনটি গান। এগুলো হলো- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ এবং ‘একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়’। অন্যদিকে জাপান-বাংলাদেশ জরিপে সেরা ২০ গানের মধ্যে প্রথম আটটিও তাঁর রচিত।

 

যত সম্মাননা

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে গুণীজন সম্মাননা। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।

 

সেরা যত গান

জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই, একবার যেতে দেনা, জন্ম আমার ধন্য হলো, গানের খাতায় স্বরলিপি, আকাশের হাতে আছে, যার ছায়া পড়েছে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, মাগো মা ওগো মা, আছেন আমার মুক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, সে যে কেন এলো না কিছু ভালো লাগে না প্রভৃতি।

 

সেরা যত ছবি

সমাধি, নান্টু ঘটক, শাস্তি, চোর, সন্ধি, স্বাক্ষর, শর্ত, স্বাধীন, সমর, শ্রদ্ধা, স্নেহ, আম্মা, পরাধীন, তপস্যা, উল্কা, ক্ষুধা, রাগী, আর্তনাদ, জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, পাষাণের প্রেম, হৃদয় ভাঙা ঢেউ।

 

শেষ ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল

চলতি মাসের ২৪ তারিখ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হবে। তাই বিবাহের অর্ধশত বার্ষিকীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে একেবারে বিয়ের আদলে সাজানোর ইচ্ছা ছিল তাঁর ও তাঁর পরিবারের। কথা ছিল গায়ে হলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বৌভাতের আয়োজনও করা হবে। এককথায় বিয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে আয়োজন করা হবে বিশাল জমকালো আয়োজন এবং মহা ধুমধামে পালন হবে দিনটি। কিন্তু ভাগ্য বড় আজব কারিগর।  তাঁর সেই ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল, অশ্রুসিক্ত নয়নে এ কথা জানালেন অস্ট্রেলিয়ায় থাকা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের শ্যালিকা নাহিদা সিদ্দিকী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর