বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

লতা মঙ্গেশকরকে দেখে হারমোনিয়াম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম

লতা মঙ্গেশকরকে দেখে হারমোনিয়াম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম

সাবিনা ইয়াসমিন, কোকিলকণ্ঠী খ্যাত বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী।  প্রায় পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্র, আধুনিক, দেশাত্মবোধকসহ নানা গান গেয়ে দেশীয় সংগীত ভান্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। সংগীতে অপরিসীম অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানসহ লাভ করেছেন অজস্র পুরস্কার। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পীর জীবনের নানা গল্প তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আপনার গানের পাঁচ দশকের ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি কেমন?

গানে গানে কীভাবে এত বছর কেটে গেল তা টেরই পাইনি। ফেলে আসা দিনগুলো আমার কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। মায়ের অনুপ্রেরণা আর বোনদের গাইতে দেখে ছোটবেলায় গানের তালিম নেওয়া শুরু করেছিলাম। এরপর থেকে গান করেই চলেছি। গানের মাধ্যমে পাওয়া অগণিত মানুষের ভালোবাসাই আমাকে এগিয়ে চলার শক্তি জুগিয়েছে। বেতার, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে কত গান গেয়েছি, সঠিক হিসাব নিজেরও জানা নেই। মানুষের ভালোবাসাই আমার প্রাপ্তি।

 

সংগীতের চলমান সময় নিয়ে কী বলবেন?

সংগীতের চলমান সময় নিয়ে আমি মোটেই খুশি নই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব পাল্টে যাচ্ছে। সিনেমায় গল্প বলার ধরন পাল্টে গেছে। আগের মতো গুণী নির্মাতা, সংগীত পরিচালক আর নেই। তাই তো গানসমৃদ্ধ ছবি নির্মাণ নেই বললেই চলে। গানের জন্যই ছবি হিট হয়, এ বিষয়টি এখন আর নেই। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন মানুষ শুধু গানের জন্যই প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছেন। সেসব দিন হারাতে বসেছি আমরা। ‘সে যে কেন এলো না’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘দুঃখ ভালোবেসে’- এমন অসংখ্য গান শ্রোতাদের মুখে আজও ফিরছে। সময়ের প্রবাহে গানগুলো পেয়েছে কালজয়ীর মর্যাদা। এখন তো এসব সৃষ্টি আর নেই।

 

আগের মতো গান ও শিল্পী এখন সৃষ্টি কেন হচ্ছে না?

এখন সবকিছুতেই চলছে বাণিজ্যিকীকরণ। তাড়াহুড়া করে সবাই কাজ করছে। গানের চেয়ে ভিডিওর প্রতি সবার মনোযোগ। ফলে ভালো গান হচ্ছে না। খেয়াল করে দেখবেন, গত ১০ বছরে সিনেমায় ম্যাসিভ হিট কোনো গান আমরা পেয়েছি? পাইনি। মাঝে মধ্যে দু-একটি গান কানে বাজলেও কয়েক দিন পরই শ্রোতারা তা ভুলে যাচ্ছে। এখন নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা ভালো ভালো কাজ করছেন ঠিকই। আশা করছি তারা গানের বিষয়গুলো নিয়েও ভাববেন।

 

এ প্রজন্মের সংগীতশিল্পীদের কীভাবে দেখছেন?

এ সময়ের অনেক তরুণ শিল্পীই বেশ ভালো কাজ করছেন। তবে তাদের অনেকেই জানেন না- কী করতে হবে, আর কী করা যাবে না। যে এটুকু বুঝতে পারবে, সে সামনে এগোবে। নয় তো ঝরে যাবে।

 

সদ্যপ্রয়াত গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গানে সবচেয়ে বেশি কণ্ঠ দিয়েছেন আপনি, তাঁর প্রয়াণ কতটা ক্ষতির কারণ?

গাজী ভাইর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলব, তাঁর চলে যাওয়া মানে সাংস্কৃতিক জগৎ অভিভাবক ও একজন শিক্ষকশূন্য হওয়া। এ ক্ষতি কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আমি তাঁর লেখা অন্তত ছয় থেকে ৭ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছি। গাজী ভাইর মতো কিংবদন্তিদের মৃত্যু নেই।

 

গান করার পাশপাশি সময় কীভাবে কাটছে?

ক্যান্সার থেকে সেরে উঠেছি তা প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। এখনো নিয়মিত চেকআপ করাই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলি। গান বা কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছাড়া বেশির ভাগ সময় বাসায় কাটাই। রোজা রাখি, নামাজ পড়ি। পাশাপাশি গানের চর্চাটাও চালু রেখেছি। যেহেতু আমি গানের মানুষ।

 

আপনার শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে কার ভূমিকা প্রধান?

মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গানের ব্যাপারটা আমার ভিতরে ছিলই। আমার মা ও নানা একসঙ্গে গান শিখতেন মুর্শিদাবাদে, ওস্তাদ কাদের বক্সের কাছে। তিনি সে সময়ের নামকরা একজন সংগীতজ্ঞ ও ওস্তাদ ছিলেন। সেই সময় মুসলিম নারীদের জন্য গান-বাজনা চর্চা করা সহজ ছিল না। পরে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সংসারে ঢুকে গান-বাজনা কিছুই হলো না আম্মার। তাই মায়ের মনে জিদ ছিল আমাদের অর্থাৎ তাঁর সন্তানদের গান শেখানোর বিষয়ে। আরেকটা ব্যাপার, আম্মা পড়াশোনায়ও অসম্ভব ভালো ছিলেন। তাও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। এ জন্য আমাদের এ দুটি দিকেই সমান মনোযোগী করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

 

সংগীতশিল্পী না হলে কী হতেন?

শিক্ষক হতাম। স্কুলের ছোট বাচ্চাদের পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষক হওয়ার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার আগ্রহ ছিল।

 

প্রকৃত শিল্পী হতে হলে কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা না থাকলে সব গান গাওয়া কঠিন। প্রতিদিন রেওয়াজ করা, প্র্যাকটিস করা, গলা সাধা প্রয়োজন। অবশ্যই শুদ্ধ উচ্চারণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

আপনার তো অনেক বড় মাপের শিল্পীদের সামনে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। দু-একটি অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?

প্রথমেই বলতে হয় লতাজির কথা। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বোম্বেতে। বোম্বেতে একবার গান গাইতে গিয়েছিলাম। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছি। ওখানে ছিলেন এস ডি বর্মন, অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ী, রাজ কুমারসহ আরও অনেকে। হঠাৎ দেখি লতা মঙ্গেশকর ঢুকছেন। তাঁকে দেখে আমি এতই ভয় পেয়ে গেছি যে, হারমোনিয়াম বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলাম। এটা ১৯৭২ সালের কথা। বয়স তখন কম ছিল। তারপর সবাই আবার জোর করে ধরে বসিয়ে দিলেন। সেখানে শচীন দেব আমাকে বললেন, আমার দেশের পল্লীর গান শোনাতে। আমি তখন ‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা...’ গানটি গাইলাম। তখন লতা মঙ্গেশকর উঠে এসে আমাকে আশীর্বাদ করলেন। সেই দিনটির কথা আমি জীবনেও ভুলব না। এরপর ১৯৭৮ সালে লতাজির সঙ্গে বোম্বেতে দেখা হয়েছিল। আমরা একটা ফেস্টিভ্যালে বোম্বে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে, তাঁর সামনে গাইতে পেরেছিলাম। সেই সফরে আমি, ববিতা, রাজ্জাক, রোজী সিদ্দিকী ছিলাম। সেখানে ছিলেন শচীন দেব বর্মণ। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘অনেক দিন বাংলা গান শুনি না। কতদিন বাংলা গান শুনি না। তুই একটা গান গা।’ তখন আমি ‘পাল তুলে দে’ গানটি গাইলাম। তিনি কাঁদলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন দেখি হঠাৎ লতাজি আসছেন। সেবারও আমি হারমোনিয়াম ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। কিন্তু আমাকে আবার ডাকা হলো। বলা হলো, গান গাইতেই হবে। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’ গাইলাম। লতাজি এত প্রশংসা করলেন, আমি বললাম, ছোটবেলায় আপনার গান শুনে বড় হয়েছি। সত্যি বলতে, এখনো প্রতিদিন তাঁর গান শুনি।

 

আপনার সংগীত জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোনটি

শ্রদ্ধেয় শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রের ‘শুধু গান গেয়েই পরিচয়...।’ ওই গান গাওয়ার পর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গানটা এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত যেখানেই যাই, সেই গানটি গাওয়ার অনুরোধ আসতেই থাকে।

 

দেশাত্মবোধক গান প্রচুর করেছেন, কোন গানটি আপনার প্রিয়?

‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’। নজরুল ইসলাম বাবুর কথা ও সুর, সংগীত করেছেন আহম্মেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ১৯৮০ সালে বিটিভির জন্য এ গানটা গেয়েছি। এই গানের কথা এবং সুর আমাকে এত বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে, গানটি গাওয়ার সময় একদম কেঁদেই ফেলেছিলাম। আমার চোখে পানি চলে আসে।  একাত্তরের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল।

সর্বশেষ খবর