শিরোনাম
সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : ফেরদৌসী মজুমদার

বাবার প্রিয় মারের বস্তু ছিল জুতা

বাবার প্রিয় মারের বস্তু ছিল জুতা

ফেরদৌসী মজুমদার গুণী অভিনেত্রী।  ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিনয়শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। থিয়েটার, চলচ্চিত্র, বেতার, টিভি নাটক- সব অঙ্গনেই তাঁর পথচলা। নিজের যাপিত জীবন নিয়ে এই কিংবদন্তির বলা কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

অভিনয়শিল্পের সব মাধ্যমেই সম্পৃক্ত ছিলেন, কতটা তৃপ্ত?

বেতার নাটক, টিভি নাটক, মঞ্চ- এই তিনটি অনেক বেশি করলেও চলচ্চিত্র বেশি করা হয়নি। ‘মেঘলা আকাশ’, ‘মায়ের অধিকার’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্র করেছি। এ জন্য সব সময় আফসোসও কাজ করে আমার মধ্যে।

 

কী সেই আফসোস?

আফসোসটা কিন্তু টিভি নাটক নিয়ে নয়। বেতার নাটক নিয়েও নয়। থিয়েটার নিয়েও নয়। আফসোসটা চলচ্চিত্র নিয়ে। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র মতো আলোচিত চলচ্চিত্রের অফার প্রথমে আমার কাছে এসেছিল। তখন আমার মেয়ে ত্রপা ছোট ছিল। ছোট মেয়েকে রেখে বাইরে গিয়ে সিনেমা করতে চাইনি। তাই করিনি। পরে ডলি আনোয়ার করে। আমিই ডলির নাম প্রস্তাব করেছিলাম। চাইলে চলচ্চিত্রে আরও বেশি কাজ করতে পারতাম। কারণ, চলচ্চিত্র অনেক বছর একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। এই মাধ্যমটা নিয়ে আফসোস আছে আজও।

 

মঞ্চকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কেন?

মঞ্চই আমার সত্যিকারের ভালোবাসা। মঞ্চ কখনই ছাড়িনি। মঞ্চের সঙ্গে কখনো আপস করিনি। অনেক কাজ ছেড়েছি মঞ্চের জন্য। সবার আগে মঞ্চকে প্রাধান্য দিয়েছি। এখনো তাই। এটা আমার কমিটমেন্ট- মঞ্চ সবার আগে। আর কিছু করি, না করি- মঞ্চে কাজ করবই।

 

১৯৬৪-তে টেলিভিশন চালু হলো, তখন প্রথম নাটকেই আপনি অভিনয় করেছিলেন। কীভাবে?

হ্যাঁ, প্রথম নাটকেই আমি অভিনয় করি। মুনীর চৌধুরীর একতলা দোতলা। আমাকে খুঁজে পেল মানে ... কলিম শরাফী ছিলেন তখন অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ। উনিই যোগাযোগ করেছিলেন। কলিম শরাফী চাইছিলেন প্রথমেই টেলিভিশনটা ফিল্মের লোকজনের হাতে চলে না যাক। তখন উনি মুনীর ভাইকে বলেছিলেন যে- আপনি তো নাটক লিখেন, নাটক করেন, আপনি ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে নিয়েই এখানে কাজ করুন।

 

দীর্ঘ অভিনয়জীবনে পছন্দ হয়নি এমন কাজ আছে কী-

না। এই দিক থেকে আমি খুব শক্ত। গল্প ও চরিত্র পছন্দ না হলে কখনো কাজ করি না। অভিনয়জীবনে এ জন্য অনেক কাজ করিনি। প্রথমে গল্প পড়ি। এরপর চরিত্র মনের মতো হলে তারপরই কাজটি করি।

 

নাটকে অভিনয়ের শুরুর গল্পটা কেমন?

আমার তো নাটকে আসার কথাই ছিল না। কারণ, আমাদের পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। আমার বাবার নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি লেখাপড়া আর নামাজ পড়া ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। আমরা চৌদ্দ ভাই-বোন ছিলাম, লেখাপড়া ছাড়া কারও স্থান ওনার কাছে ছিল না। ভাইদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি পড়াশোনা করতে চাইতেন না। স্কুলে যাওয়ার পথে গাছের নিচে বই মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন এবং বিকালে বাড়ি ফিরতেন। বাবা তো বুঝতে পারতেন না, পরে দেখা গেল হেডমাস্টার বাসায় এসে হাজির। সব জেনে বাবা বললেন ওর কোনো ভরণ-পোষণ আমি দেব না। মা তো কান্নাকাটি লাগিয়ে দিলেন। মা ছিলেন খুবই সরল মানুষ। ঘোমটা টেনে কেবল নীরবে কাঁদতেন। কিন্তু বাবার কাছে এসব কান্নাকাটির কোনো মূল্যই ছিল না। বাবার প্রিয় মারের বস্তু ছিল জুতা। গালাগালি করতেন আর জুতা খুলে মারতেন হা হা ... তো আমার যদ্দুর মনে পড়ে, আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, তখনো জুতার বাড়ি খেয়েছি হা হা। আর ওই যে বললাম আমার এক ভাইকে উনি ভরণ-পোষণ করাবেন না বলেছেন, ওর নাম রুশো, আসল নাম শামসের চৌধুরী। আমার বড় আপার নাম ছিল নাদেরা বেগম, উনি থাকতেন করাচি ... তো তিনি বললেন যে- আমি রুশোকে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলেন, সেখানেই সে বিএ পাস করল, এমএ পাস করল, তারপর বিয়ে করল।

 

কবীর চৌধুরী বা মুনীর চৌধুরী, কেমন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব?

আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, ফার্স্ট ইয়ারে, মুনীর ভাই তখন বাংলা বিভাগের শিক্ষক। কবীর ভাই বোধ হয় তখন বরিশাল বিএম কলেজে। কবীর ভাইয়ের চেয়ে মুনীর ভাইকে আমরা কাছে পেয়েছি বেশি। কারণ, কবীর ভাই চাকরি সূত্রেই বাইরে বাইরে থেকেছেন। মুনীর ভাইয়ের হাঁটা, চলা, কাপড় পরা, কথা বলা ... সবকিছুই ছিল অনুকরণীয়। ওনার ভাষাটা ছিল উচ্চমার্গীয়, শব্দচয়ন, শব্দ প্রয়োগ এগুলো আমাদের মুগ্ধ করত।

 

আপনি ওনার কবর নাটকটি পড়েছেন কবে?

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি ১৯৬১ সালে। ’৬৩-’৬৪ সালের দিকে আমি প্রথম নাটকের সঙ্গে যুক্ত হই। ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীতে তখন মুনীর ভাইরা অভিনয় করতেন। উনি চোরের অভিনয় করছেন, সবাই বলছে অসাধারণ! কিন্তু আমার আবার নিজের ভাই তো অতটা মনে করতাম না। আবার সবাই যখন বলছে ... তখন ভাবলাম ওনার কবর নাটকটা পড়ি। তো পড়ে তো ভয় লাগল যে, কবর থেকে উঠে আসছে ... মানে এভাবে নাটক হয়! পরে ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে বুঝলাম যে এটা কী মানের নাটক!

 

তাহলে আপনার নাটক শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?

না, কলেজেও করেছি। ইডেন কলেজে পড়ার সময় এক দিন মুনীর ভাই বললেন- নাটক করবি? আমি বললাম যে, আমি আবার কী নাটক করব? উনি বললেন- কেন তুই তো সবাইকে নকল করে আমাদেরকে দেখাস ... সেটাই করবি। মানে হলো আমার আবার ছোটবেলা থেকেই একটা ঝোঁক ছিল বাসায় যে আসত তার কিছু না কিছু নকল করতাম। বাবা কীভাবে বকেন, কীভাবে মারেন ... এসব আরকি! কিন্তু মুনীর ভাই এসে যখন বললেন- নাটক করবি? তখন চট করে বাবার চেহারাটা ভেসে উঠল।

 

নির্দেশনার কাজ কীভাবে এনজয় করতেন?

অভিনয়ের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি এনজয় করতাম না। এটা খুব কঠিন কাজ। তবে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আমি বুঝেছি যে- অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভিতরে মালমসলা না থাকলে পিটিয়েও কিছু বের করা যায় না। আর নির্দেশনার কাজে আমি আগ্রহীও ছিলাম না, মামুন ভাইয়ের চাপে পড়ে দিতে হয়েছে।

সর্বশেষ খবর