সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

সময় ফুরিয়ে আসছে আর বেশি দিন গাইতে পারব না

পান্থ আফজাল

সময় ফুরিয়ে আসছে আর বেশি দিন গাইতে পারব না

‘আমি বুড়ো হয়েছি; কিন্তু বড় হইনি। বড় হলে কেউ পাঁচবার বিয়ে করে? মানুষ একবার দুবার করে। তাই বলে পাঁচবার? কতটা আহম্মক আমি, প্রেমে পড়ছি তো পড়ছিই। প্রেমে পড়ছি ঠিক আছে, তাই বলে বিয়ে করতে হবে? করছি তো করছি। প্রতিনিয়ত প্রেমে পড়ছি।’ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার মঞ্চে গাইছিলেন কবীর সুমন। আর গানের ফাঁকে ফাঁকে এমন প্রেমময় কথার বুলি আওড়াচ্ছিলেন উপস্থিত ভক্তদের সামনে। ১৩ বছর পর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মঞ্চে পিপহোলের আয়োজনে ‘তোমাকে চাই’র ৩০ বছর উদযাপনে নিজেকে  মেলে দিলেন দুই বাংলার গানের এই প্রিয় মানুষটি।

দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমাণ দর্শক-শ্রোতার উদ্দেশে সুমন বলেন, ‘আপনারা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন, আমরা গান বাজনাটা শুরু করে দেই। আগে যতবার এসেছি আমি একাই এসেছিলাম, এখন আমি বুড়ো হয়েছি, উঠতে অসুবিধা হয়, বসতে অসুবিধা হয়, আমার সাহায্য দরকার হয়, হতেই পারে আমার বয়স হয়েছে। আমার চোখ খারাপ, কান খারাপ; মন ছাড়া সবই খারাপ।’

নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়ে সুমন বলেন, ‘আমার একটা অসুখ হয়েছে, এটা স্নায়ুর অসুখ, এই অসুখের কারণে আমি যেমন হাতে লিখতে পারি না তেমনই গিটারও বাজাতে পারি না। আর কোনো দিন পারব না। একটানা বসে থাকলেও সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় শুয়ে শুয়ে গান গাই! তবে এ জন্য আমার আলাদা কোনো দুঃখ নেই। গুরুদের কৃপায় আমি এখনো একটু একটু গান গাইতে পারি, এটাই আনন্দ। ফলে আমার সঙ্গে বাজানোর জন্য বন্ধুদের দরকার হয়।’ এরপর গলা ছেড়ে গাইতে থাকলেন একের পর এক মুগ্ধতার গান। এদিনও তাকে পাওয়া যায় সেই চিরচেনা হাসিমুখে। পরনে হাফহাতা জলপাই রঙের লং পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। চোখে মোটাফ্রেমের চশমা। গানের ফাঁকে ফাঁকে গলা ভেজাচ্ছিলেন।

তবে একটানা বসে থাকলেও যে তার গান গাইতে সমস্যা হয় সেটা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় শুয়ে শুয়ে গান গাই! আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে বাংলাদেশে বসে গাইছি। আমার বয়স প্রায় ৭৪। এখনো যে এই বুড়োর গান শোনার জন্য মানুষের এত আগ্রহ, এটা আনন্দ দেয়। আগ্রহী দর্শকদের বেশিরভাগই তরুণ, এটাও আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের।’ সুমন ফের বলেন, ‘আমি ভারতের নাগরিক। আমার মাতৃভাষা বাংলা, যেটি এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। এর চেয়ে গর্বের কিছু হতে পারে না। প্রথম বাংলাদেশে গান করতে এসেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তখন আমার বয়স ৪৭ বছর। আমার প্রথম স্বরচিত, স্ব-সুর আরোপিত গানের অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’ যখন বেরিয়েছিল তখন আমার ৪৩ বছর বয়স। আমার প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড রবীন্দ্রনাথের গানের, যখন বেরিয়েছিল তখন আমার ২৩ বছর বয়স। আর আমার যখন ১৭ বছর বয়স তখন আমি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে রবীন্দ্রসংগীত-আধুনিক গানের একটু উঁচু দিকের একজন গায়ক হিসেবে ঢুকেছি। আর নজরুলগীতিটা ওই সময় ভালো গাইতে পারিনি তাই ওটাতে আমি বি-গ্রেড পেয়েছিলাম। এই হচ্ছে মোটামুটি আমার গানের ক্যারিয়ার।’ এরপর তার সফরসঙ্গী তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর সুমন শোনালেন ‘একেকটা দিন’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘সূর্যোদয়ের আগে’, ‘জাগে জাগে রাত’ শিরোনামের গান। ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’ গানটি গাওয়ার এক পর্যায়ে সুমন হলের সামনের অংশে আলোকিত করার কথা বলে মজা করে বলেন, ‘আলোকিত এই সুমনে দেখবেন আর আমি বাংলাদেশের প্রিয়জনদের দেখব না-তা কি হয়!’ গানটি শেষ হতেই মাগরিবের আজানের সময় হাত নেড়ে সবাইকে নীরব থাকার আহ্বান জানান শিল্পী।

বাংলা ভাষার প্রতি সুমনের অগাধ ভালোবাসা, তা তিনি হরহামেশাই বলেন। গানেও সেই ছাপ স্পষ্ট। বাংলাদেশের প্রতিও এই কিংবদন্তির ভালোবাসার ঘাটতি নেই। লাল-সবুজের এই দেশটির সঙ্গে যেন তার আত্মার সম্পর্ক। তাই তো বারবার গানের কথা-সুরে বহুবার তুলে ধরেছেন এই দেশের কথা, সীমান্তের কথা, মানুষের কথা। জানিয়েছেন বিভেদ ভুলে বাঙালিয়ানায় মিশে যাওয়ার আহ্বান। মঞ্চে এসে এক ঘণ্টা সুর আর কথার মায়ায় বাঁধলেন কবীর সুমন। এরপর হঠাৎই অসুস্থবোধ করলে একটু বিরতি নেন তিনি। যাওয়ার আগে শোনালেন বাংলাদেশ নিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতির কথা। হাতের পাশে রাখা ইনহেলার দেখিয়ে বললেন, ‘ভয় পাবেন না, মরব না। এমন ভাগ্য করে জন্মাইনি যে, বাংলাদেশের মাটিতে মরব।’ এই কথার সঙ্গে রেশ টেনে দিয়ে আবেগি হয়ে ব্যক্ত করলেন, ‘আমি গানখেকো, গানখোরদের দলে। তবে বেশি দিন গাইতে কিন্তু পারব না, সময় ফুরিয়ে আসছে।’ তার এমন কথায় মুহূর্তেই পুরো হলরুমে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। এরপর তিনি নিজেই নীরবতা ভেঙে বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, যতই বড় হচ্ছি, ততই বুড়ো হচ্ছি।’ সাময়িক অসুস্থতা কেটে গেলে ১৫ মিনিট বিরতি নিয়ে আবার গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। গানের মাঝে মাঝে গল্পে মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। সুমন বলেন, ‘এক সময় কথায় কথায় কেঁদে ফেলতাম। এখন কাঁদতে ইচ্ছে করে আবার চেপে যেতেও ইচ্ছে করে। ইতালির সাহিত্যিক ইতালো কানভিনো বলেছেন, একটা পর্যায়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তার চারপাশটা মৃত হয়ে যায়। আমার বাবা-মা, ওস্তাদ সবাই মারা গেছেন। আজ মনে হচ্ছে তারা যদি আজকের এই দৃশ্যটা দেখতে পেতেন?’ আবেগ ভরা কণ্ঠে তিনি বলে চলেন, ‘আপনারা এত সুন্দর করে আমার সঙ্গে গাইছেন অবাক লাগছে। আপনারা গান খান, গান যাপন করেন।’

কবি শহীদ কাদরীর বিখ্যাত কবিতাকে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ সুর দিয়েছিলেন সুমন, অনুষ্ঠানে গেয়ে শোনালেন সেটি। গানের ফাঁকে তার বন্ধু শহীদ কাদরীর স্মৃতিচারণাও করলেন আবেগ দিয়ে। জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালকে নিয়ে তাঁর লেখা গান ওই তো লক্ষ ছেলেমেয়ে দামাল নাতি-নাতনি দামাল, সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে সুফিয়া কামাল’ শোনালেন। তারপর কণ্ঠে তুলে নিলেন ‘বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত গান’। এরপর পরিবেশনা করলেন ‘যত ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ’ ও ‘কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে’সহ প্রিয় কিছু গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে একপর্যায়ে তার মনে উঁকি দিল ফেলে আসা দিনের একটি অধ্যায়। তখন তিনি জার্মানিতে। পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, এমন বিপদে পথ না পেয়ে জার্মানিতে চলে যান সুমন! সেখানে গিয়ে চাকরি নেন জার্মান বেতারের বাংলা বিভাগে। কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে। সেই সাংবাদিকদের নাম-স্মৃতি এখনো কবীর সুমনের মনে জ্বলজ্বল করছে। তাদের নাম বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে জানালেন, ‘কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে, কেউ অন্য দেশে। আর একজন এখনো ঢাকাতেই আছেন, তার নাম শাহজাহান ফারুক।’ সুমন যখন বললেন, ‘আমি জানি না, শাহজাহান ফারুক এখানে আছেন কিনা’। কথা শেষ না হতেই দর্শক সারি থেকে একটি হাত উঁচুতে উঠল, আশপাশ থেকে সজোরে বলা হলো, ‘আছে...’। চমকিত, বিস্মিত কবীর সুমন বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে না পেরে স্টেজের কিনারে থাকা লোকজনকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘আমাকে ধরো, দাঁড়াতে হবে।’ এরই মধ্যে  সাংবাদিক শাহজাহানও মঞ্চে উঠলে সুমন হারিয়ে ফেলা বন্ধুকে আবেগে জড়িয়ে ধরেন। সুমন ছলছল চোখে অকপটে জানালেন, ‘খুব কষ্টে কান্না চেপে রাখছি।’ কিন্তু না, পুরোটা পারলেন না; অগত্যা রুমাল দিয়ে চোখজোড়া মুছে সুমন মৃদু হেসে বললেন, ‘জীবনটা কি সুন্দর না!’ এই দৃশ্যে করতালিতে মুখরিত হয় পুরো অডিটোরিয়াম। আবেগি মুহূর্ত শেষ হলে এরপর সুমন ‘রেখাবের রূপ’ ‘জাগে জাগে রাত’, ‘কাঙালপনা’, ‘মন খারাপ করা বিকেল’, ‘বয়স আমার’, ‘বিসমিল্লাহর পাগলা সানাই’, ‘গানওলা’ পরিবেশন করেন। এদিন শুধু আধুনিক বাংলা গান গেয়ে শোনান সুমন। তিনি মঞ্চে বসেই বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে পেনশন পাই। এ ছাড়া কয়েকজনকে আধুনিক বাংলা গান শেখাই, তারা কিছু দেন। তাতেই সংসার চলে। আমাকে এখন কেউ ডাকে না। বিনোদন শিল্পে বুড়োদের জায়গা নেই। বুড়োদের জায়গা আছে ডাক্তারি ও ওকালতিতে। তাছাড়া অনেকে আমায় পছন্দ করেন না নানা কারণে। আমি কথা দিচ্ছি, এই মঞ্চেই যদি সুযোগ হয়, আমি আবার গাইব বিনামূল্যে।’ তিনি এই কথার রেশ টেনে আরও বলেন, ‘এই কথাটা আমি বাংলাদেশকে বলছি। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি আর একবার বাংলাদেশে আসতে চাই। সে অনুষ্ঠানে বলতে চাই, ‘কোন সুরগুলো কোন গানগুলো আমায় পুষ্ট করল? সেই স্মৃতির কথা বলব। আমি আরেকবার বাংলাদেশে আসব। তবে সেবার কোনো টাকা নেব না। দায় থেকে গাইব। আমার গান শোনানোর দায়। বিদায় পরিচিতা, আমি একা তুমি একাই...’ ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ‘তোমাকে চাই’ দিয়ে সুমন শেষ করেন সুর-ভ্রমণ। কবীর সুমনের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে ছিলেন ধ্রুব বসু রায়, ইন্দ্রজিৎ প্রধান।

সর্বশেষ খবর